ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ, আশপাশের অঞ্চল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৫ আগস্ট ২০১৬

শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ, আশপাশের অঞ্চল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মঙ্গলবারের মৃদু ভূমিকম্পের পর বুধবার বিকেলে শক্তিশালী ভূমিকম্পে আবারও কেঁপে উঠল সারাদেশ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পার্শ্ববর্তী উত্তর-পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তীব্র কম্পন অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৮, যা শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবেই চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চাউক এলাকায়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের হিসাব অনুযায়ী ভূউপরিভাগের ৮৪ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে এটি অনুভূত হয়। এদিন সকালে ইতালির একটি ভূমিকম্পে সেদেশের একটি শহর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতালিতে ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিয়ানমারের ভূমিকম্পে কাঁপল রাজধানী ঢাকা ও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম, বর্ধমান, জলপাইগুড়িসহ রাজ্যের সব জেলা কেঁপে উঠেছে। এর রেশ অসম ও বিহারে ছড়িয়ে পড়ে। রাঁচি, শিলং, গুয়াহাটিতে জোরালো কম্পনের খবর পাওয়া গেছে। এর প্রভাবে আতঙ্কিত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আতঙ্কে বহুতল ভবন থেকে নিচে নেমে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রের পরিচালক ও ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার জানান, ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকায় এর কম্পনের তীব্রতা ছিল (মডিফাই মার্কারি ইনটেন্সিফাইড এমএমআই) মাত্র ৩ মাত্রার। তবে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কম্পনের তীব্রতা ৪ মাত্রায় অনুভূত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, মিয়ানমারের চাউকের ৮৪ কিলোমিটার পশ্চিমে জনবসতিহীন এলাকায় এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থলে ৫৩ মাইল মাটির গভীর থেকে এটির উৎপত্তি হয়েছে। ঢাকা থেকে ৫৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে ছিল উৎপত্তিস্থল। তবে ভূমিকম্পের কারণে দেশে কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভয়ে বাসা ছেড়ে অনেকেই রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় মোবাইলে স্বজনদের খোঁজখবর নিতে দেখা গেছে। আতঙ্কিত লোকজন দিগি¦দিক ছুটতে থাকে। অনেকে ভয়ে বাসার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। অনেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। বুবধারের ভূমিকম্পের একদিন আগেই মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপেছিল দেশের বিভিন্ন এলাকা। একদিন বাদেই আবার শক্তিশালী ভূমিকম্প ভাবিয়ে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঘন ঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি তার প্রমাণ। তারা বলছেন, এত ঘন ঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। সম্প্রতি এর হার অনেক বেড়ে গেছে। মৃদু ভূমিকম্পের পাশাপাশি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানছে। গত দেড় বছরের কম সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের আশপাশ এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের পাঁচটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। এর পাশাপাশি একাধিকবার মৃদু ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ২৫ এপ্রিল শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে পার্শ্ববর্তী দেশ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর মানবিক বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই মে মাসেই আরও একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এরপর মনিপুরের ইম্ফল ও মিয়ানমারে আরও দুই দফায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ প্রচ- কেঁপে ওঠে। সর্বশেষ বুধবার সংঘটিত শক্তিশালী ভূমিকম্পেও গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। মঙ্গলবার দেশের বিভিন্নস্থানে রিখটার স্কেলের ৫.৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ঢাকা থেকে যার উৎপত্তিস্থল ছিল ৪০৯ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের মলাইক এলাকায়। বুধবার এর আশপাশ এলাকা থেকেই শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। মঙ্গলবারের ভূমিকম্পটি কেন্দ্রস্থলের ভূউপরিভাগে ১০৬ কিলেমিটার গভীর থেকে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির অনেক গভীর থেকে এবং ঢাকা থেকে বহু দূরে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়ার কারণে কম্পনের তীব্রতা ছিল অনেক কম। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে কম্পন যত দূরে যাবে ততই এর তীব্রতা কমে আসবে। বুধবার বাংলাদেশে কম্পনের তীব্রতা অনুভূত হয়েছে ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি দেশে উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় ভূমিকম্পের হার বেড়ে গেছে। যদিও এ পর্যন্ত উৎপত্তি হওয়া সব ভূমিকম্পই ছিল দেশের বাইরে। তারা বলছেন, এ এলাকায় তিন বাউন্ডারিপ্লেটের সংযোগস্থল। আর এ সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ কারণে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের মতো ভূমিকম্প ঝুঁকির তালিকায় ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সম্পতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায়ও তা উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণায় সম্প্রতি উল্লেখ করা হয়েছেÑ দুটি গতিশীল ভূগাঠনিক প্লেটের পরস্পরের দিকে চাপাচাপির ফলে এ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক তিনটি টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারির সংযোগস্থলে। এসব প্লেট বাউন্ডারির থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক ওই গবেষণা মতে, ভারতের পূর্ব অংশ ও বাংলাদেশের যে অঞ্চল সম্ভাব্য সেই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তার ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বসবাস। ওই গবেষণায় আরও বলা হয়Ñ এই মর্মে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, বিগত ৪শ’ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল বলে বিবেচিত বাংলাদেশের ভূস্তরের নিচের সাবডাকশন জোনে টেকটোনিক প্লেটগুলোতে প্রবল চাপ জমা হচ্ছে। আর তা এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে রূপ নিতে চলেছে। বিশাল সাবডাকশন জোনটি হচ্ছে মূলত এক অতিকায় টেকটোনিক প্লেট, যা কোটি কোটি বছর ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে এশিয়ার দিকে একটু একটু করে সরে আসছে। এ চাপটি ভূস্তরের নিচের দিকে আবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ভূমিকম্পের খবর ॥ স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম থেকে জানান, বুধবারের ভূমিকম্পের কারণে লোকজন ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে নেমে আসে। অনেককে আতঙ্কে ভীত হয়ে চিৎকার দিতে দেখা গেছে। ভূমিকম্পের পর ক্ষয়ক্ষতির খবর নিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বেরিয়ে পড়েন। তবে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। স্টাফ রিপোর্টর রাজশাহী থেকে জানান, ভূমিকম্পে মহানগরীর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসিক হল ও একাডেমিক ভবন ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। নওগাঁ সংবাদদাতা জানান, বুধবার বিকেলে দুই দফায় জেলাজুড়ে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। ২ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল ভূমিকম্প। উঁচু ভবনে কর্মব্যস্ত ও বসবাসকারী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এছাড়া সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, মাগুরা, বগুড়া, জয়পুরহাট, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, পাবনা ও পটিয়া থেকে রিপোর্টার জানান, বুধবারের ভূমিকম্পে জেলার বিভিন্ন এলাকায় কম্পনের খবর পাওয়া গেছে। এ সময় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। মসজিদে আজান দেয়া হয়। আতঙ্কিত লোকজন বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের স্বজনদের খোঁজখবর নিতে থাকে। প্রাপ্ত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দেশের কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
×