ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধীর সন্তানদের নিয়ে দল গঠন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী

দেশের স্বাধীনতায় বিএনপি কি বিশ্বাস করে?

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৫ আগস্ট ২০১৬

দেশের স্বাধীনতায় বিএনপি কি বিশ্বাস করে?

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য পুনরায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করে বলেছেন, ওই বীভৎস্য ঘটনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছেলে ও তার মন্ত্রী-নেতারা যে জড়িত ছিলেন এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তদন্তেই তা বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ঘোষিত বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সমালোচনা করে তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও বংশধরদের নিয়ে দল গঠন করা বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কিনা- সেটিই প্রশ্ন। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতা, মানুষের শান্তি ও উন্নয়নে বিশ্বাস করে না, এটিই বাস্তবতা। আসলে বিএনপি ২০০১ সালের হত্যা-ধর্ষণ, দুর্নীতি ও লুটপাটের চরিত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অসচ্ছল, অসুস্থ ও দুর্ঘটনায় আহত সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশ কল্যাণ ট্রাস্টের সহায়তা ও অনুদানের চেক বিতরণকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোট ১৯৬ সাংবাদিক ও নিহত সাংবাদিককের পরিবারের মধ্যে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকার অনুদানের চেক তুলে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ ও নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকের সুখ-দুঃখের কথা আগ্রহের সঙ্গে শুনে তা সমাধানের আশ্বাস দেন। এর আগে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে সাংবাদিক নেতারা সংবাদপত্রে নবম ওয়েজবোর্ড গঠন, সব সংবাদপত্রে অষ্টম ওয়েজবোর্ডের পুরোপুরি বাস্তবায়ন, সাংবাদিকদের আবাসন এবং বঙ্গবন্ধু সরকার গঠিত ‘নিউজ পেপার এমপ্লয়িজ এ্যাক্ট-১৯৭৪’ পুনর্বহালের দাবি জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার কাছে কোন কিছু চাইতে হয় না। নিজ থেকেই সবকিছু দেই। সাংবাদিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপনে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ কাজ করেছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা কেউ আমাকে কোন পরামর্শ দেননি, কিংবা দাবিও জানাননি। নিজের ইচ্ছা ও উদ্যোগেই এটি করেছি। ৮ম ওয়েজবোর্ড আমরা দিয়েছি। আপনারা নবম ওয়েজবোর্ডের দাবি তুলেছেন। এখানে মন্ত্রী আছেন (তথ্যমন্ত্রী), আমি বলব, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মনজুর আহমদ। আরও বক্তব্য রাখেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ, বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, মহাসচিব ওমর ফারুক, ডিইউজের সভাপতি শাবান মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে কেউ এসেছিলেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে, কেউ কৃত্রিম পায়ে হেঁটে। সাংবাদিক ছেলেকে হারিয়ে এসেছিলেন মা, স্বামীকে হারিয়ে এসেছিলেন বিধবা স্ত্রী। রোগে ভুগে কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন অসচ্ছল হয়ে পড়া সাংবাদিকরাও এসেছিলেন। সাংবাদিকতার মতো দায়িত্বশীল এই পেশায় কর্মকর্তা কিংবা এক সময়ের সংবাদকর্মীদের এমন অবস্থায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুদানের চেক হস্তান্তরকালে অনেক মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেও সান্ত¡না দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা। সাংবাদিকদের দায়িত্বের সঙ্গে কর্তব্য পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। স্বাধীনতা ভাল, কিন্তু সে স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে দেশ, জাতি ও মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আমরা সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেখতে চাই। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ গোটা জাতি সোচ্চার। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। আমরা জনগণের শক্তিতে বিশ^াসী। জনগণের মাঝে যদি আমরা সচেতনতা গড়তে পারি তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন। এদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কোন স্থান হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকতে তারা দুর্নীতি-লুটপাট ও মানিলন্ডারিং করে বিপুল অর্থ কামাই করেছে। এই অর্থ ঢেলে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে বিদেশে লবিং ও তদবির করা হচ্ছে। কিন্তু এই বিচার চলতে থাকবে। আমাদের যে সিদ্ধান্ত তাতে আমাদের অটলও থাকতে হবে। আমরা তা থাকব। আমার ক্ষমতা হারানোর ভয় নেই, জীবন হারানোরও ভয় নেই। কোন অন্যায়ের কাছে মাথানত করব না। নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছি বাংলাদেশের মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই, কেউ-ই তা বন্ধ করতে পারবে না। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময়ের সরকার গ্রেনেড হামলার আলামত সংরক্ষণ না করে যত দ্রুত সম্ভব তা ধ্বংস করে ফেলে। এমনকি যে সামরিক কর্মকর্তা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড সংরক্ষণ করতে চেয়েছিলেন, তাকেও পরে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়। হামলার পর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরেও গ্রেনেড পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কারাগারের ভেতর কীভাবে গ্রেনেড ঢুকলো? এর মধ্য দিয়ে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সে সময়ের সরকারের সম্পৃক্ততা প্রমাণ হয়। বিএনপির নতুন কমিটির কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ৫শ’রও বেশি সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটিতে কারা স্থান পেয়েছে? যেসব যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটে জড়িত, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, যাদের বিচার ও বিচারের বাংলার মাটিতে কার্যকর হয়েছে- তাদেরই বংশধর ও ছেলেদের নিয়েই বিএনপি দল গঠন করেছে। তাহলে সেই দল কী এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতে পারে? সেই দল কী এদেশের মানুষের জন্য শান্তি-কল্যাণ আনতে পারে? বিএনপি-জামায়াত জোটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এরা ক্ষমতায় থাকতে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করেছে তাদের সেই চরিত্র এখনও বদলায়নি। এখনও তারা জঙ্গীবাদকে উস্কে দিচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার চেতনা ধ্বংস করে ভিন্ন চেতনা নিয়ে আসতেই ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল। এটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। আর দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। স্বাধীনতাবিরোধীরা তাঁর সে লক্ষ্য পূরণ করতে দেয়নি। গণমাধ্যমের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সে স্বাধীনতা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে উপভোগ করতে হবে। যত খুশি সমালোচনা করুন তাতে আপত্তি নেই। তবে সে সমালোচনা অবশ্যই গঠনমূলক হতে হবে। যেন গণমাধ্যমের সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যে কোন ভুল সংশোধনের সুযোগও থাকে। তিনি বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর আমরা দেখেছি কোন কোন টিভি চ্যানেল কীভাবে অভিযান চালানো হবে, পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার সবই সরাসরি সম্প্রচার করে হামলাকারীদের জানিয়ে দিয়েছে। এতে ভেতরের জঙ্গীরাও টিভি দেখে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কে কোথায় পালিয়ে রয়েছে- সেটিও যখন সংবাদ হয়ে যায়, তখন জঙ্গীরা তো তাদের বের করে হত্যা করতেও পারে। তাই আগামীতে এ ব্যাপারেও সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের খবরে মৃতদেহের বীভৎস্য সব ছবিও দেখানো হয়। অথচ ইউরোপ, আমেরিকায় এমন হত্যাকা- এখন প্রায়শই ঘটলেও বিশে^র বড় বড় সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও সিএনএন তা দেখাচ্ছে না। এসব গণমাধ্যমের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে দেশের গণমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। নিজেকে গণমাধ্যম পরিবারের একজন হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম জাতির পিতার কাছ থেকে। কেননা আমার বাবা জাতির পিতা ছাত্র রাজনীতি করার সময় পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি পত্রিকা বের করে নিজ হাতে বিক্রিও করেছেন। জাতির পিতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি ছিলেন। সেদিক থেকে আমিও গণমাধ্যম পরিবারেরই একজন সদস্য। অনলাইন পত্রিকার জন্য নীতিমালা করা জরুরী মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি অনলাইন পত্রিকার নীতিমালা করে ফেলব। সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমরা চাই দেশে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা হোক। কেউ যাতে অশ্লীলতা ছড়াতে না পারে সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। সাংবাদিক হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি নিজেই আমার পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছি। তাদের হত্যার বিচার পেতে আমাকেও ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না। তবে একজন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়েছে, বাকিগুলোরও হবে। এজন্য সাংবাদিকদেরও সহযোগিতা দরকার। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে ১০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিক রয়েছেন, যাদের কাছে কোটি টাকার অনুদানও কোন বিষয়ই নয়। তাদেরও আগ্রহী করে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে নিজেই এ ধরনের তহবিল গঠন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন- এমন ঘোষণা দিয়ে হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি উপস্থিত থাকলে কেউ কম টাকার চেক নিয়ে আসতে পারবেন না। এর চেয়েও বড় অঙ্কের চেক আসতে পারে।’ অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক, প্রধান নির্বাহী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় অন্যদের মধ্যে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলমগীর, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, বাসসের এমডি আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক বর্তমানের উপদেষ্টা সম্পাদক রাহাত খান, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, চ্যানেল আইয়ের এমডি ফরিদুর রেজা সাগর, মাছরাঙা টেলিভিশিনের সিইও অঞ্জন চৌধুরী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের এমডি এস এম হারুন অর রশিদ, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, সিনিয়র সাংবাদিক স্বপন কুমার সাহা, প্রধান তথ্য কমিশনার কাজী গোলাম রহমান, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা একেএম শামীম চৌধুরীসহ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×