ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ফিরে দেখা ২১ আগস্ট, ২০০৪

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৪ আগস্ট ২০১৬

ফিরে দেখা ২১ আগস্ট, ২০০৪

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) সেদিন রাতে ও পরদিন আমি বুলেট ও স্পিন্টারে আহতদের দেখি- অন্যদের মতো সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও কাজী জাফরউল্লাহকে শমরিতা হাসপাতালে, আবদুর রাজ্জাক ও ওবায়দুল কাদেরকে শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, মোহাম্মদ নাসিম, বাহাউদ্দীন নাসিম ও বজলুর রহমানকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শাহজাহান ও দীপ্তিকে অন্য একটি হাসপাতালে এবং আরও প্রায় ৩০ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে এসে হামলায় নিহত ১৮ জনের লাশ ময়নাতদন্তের পর নেয়ার জন্য অপেক্ষা করি। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টা পর রাত ৮.৩০ মিনিটের দিকে পুলিশ এদের লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। ২২ আগস্ট বিকেলে শোক মিছিলে যাতে আমরা লাশ নিয়ে যোগ দিতে না পারি তার জন্য ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ লাশ হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটিয়েছিল। এই সময় জানা যায় যে, বঙ্গীয় পুলিশ প্রবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ না করে দায়সারাভাবে এসব লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করা হয়েছিল। এই নারকীয় অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের লক্ষ্যে এই দুদিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা করা বা জবানবন্দী নেয়া হয়নি। ঐ ২২ আগস্ট তারিখেই এ ঘটনার ওপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সইকৃত এজাহার রমনা থানার পুলিশ গ্রহণ করেনি। গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে রমনা থানার পুলিশ বলেছে যে অকুস্থল বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ রমনা থানা নয়, মতিঝিল থানার অন্তর্ভুক্ত। অথচ ময়নাতদন্ত করার জন্য নিহতদের লাশ নিয়ে এসে তদন্ত শেষে লাশগুলো হস্তান্তর করতে রমনা থানার পুলিশই উপরের কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছে। এই এজাহার ওইদিন মতিঝিল থানায়ও গ্রহণ করা হয়নি। মতিঝিল থানার তরফ হতে এজাহার গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তারা এর আগে একই ঘটনার বিষয়ে একজন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে এজাহার গ্রহণ করেছে। একই ঘটনার বিষয়ে তাদের মতে দ্বিতীয় এজাহার ওইদিন ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে ভাংচুর ও পুলিশকে কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের দেয়া এই এজাহারটি নিঃসন্দেহে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে জনগণের মনোযোগ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় প্রযুক্ত হয়েছিল। ২১ আগস্ট ১৮ জন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমানসহ আরও তিনজন কর্মী একই হামলায় আহত হন। এদের মধ্যে অনেকেই এত গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন যে এদের জন্য দেশের বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আহতদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক কর্মী পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার বা হেনস্তা হওয়ার আশঙ্কায় গণহাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাননি। পুলিশ যেসব লাশ নিয়ে গিয়েছিলেন সে সময় সে লাশগুলো শোনা যায়, ২২ আগস্টের রাতে শাহাজাহানপুর গোরস্থানে লোকচক্ষুর আড়ালে মাটিচাপা দেয়া হয়। সে রাতে দু’শতাধিক পুলিশ গোরস্থান ঘিরে তাদের যা করতে বলা হয়েছে তাই করেছে বলে শোনা গেছে। ২১ তারিখ রাতেই আহতদের চিকিৎসা এবং নিহতদের অসহায় পরিবার-পরিজনকে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা একটি বিশেষ তহবিল খোলেন। এক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও সরকার আহতদের চিকিৎসা বা সহায়তা দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ২২ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে দেখি তারা তাদের পরিজন ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দিয়ে স্যালাইন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনে আনছেন। এই হাসপাতালে তাদের প্রতি চিকিৎসামূলক মনোযোগ হয় সামান্য মাত্রায় দেয়া হয়েছে, নয় একবারেই অনুপস্থিত ছিল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র সচিব, তাদের অফিস থেকে এই নারকীয় ঘটনার স্থান ৩০০ গজের বেশি না হওয়া সত্ত্বেও তা সরেজমিনে দেখতে যাওয়ার সময় পাননি। পুলিশের মহাপরিদর্শক, মহানগরের পুলিশ কমিশনার ও তার ডেপুটিগণ ঘটনাস্থল দেখতে গিয়েছিলেন কিনা জানা বা দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরণ ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব সংগঠনের প্রধানদের এই আচরণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে তারা এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। আমার বিবেচনায় এই নারকীয় অপরাধের ঘটনা উঁচু পর্যায়ে কর্মরত কিংবা যোগসূত্র সংবলিত কতিপয় ব্যক্তি ঘটানোর জন্য অতীব যতেœর সঙ্গে পরিকল্পনা করেছিল। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমরাস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী একটি ভাড়াটে দল। আর এতে সহযোগিতা করেছিল পুলিশ ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ভাড়াটিয়া পেশাদার সন্ত্রাসীরা, যাদের ছত্রছায়ায় হামলাকারীরা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। পরে আমি জানতে পারি যে, এর আগে ১৬ ও ১৮ আগস্ট শেখ হাসিনার টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থানের সময় তাঁকে লোকবল ও অস্ত্রের মানে পুলিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আগের চেয়ে অনেক বিস্তৃত স্কেলে প্রতিরক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ২১ আগস্টে অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ মিছিলপূর্ব সভায় তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতার মাত্রা কমিয়ে আমাদের দল থেকে সাধারণত দেয়া নিরাপত্তার বেষ্টনী টেনে ধরার অসৎ উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছিল। সুপরিকল্পিতভাবে এসব লোক দেখানো ব্যবস্থার মোড়কে দৃশ্যত পুষ্পশোভিত পথ ধরে টেনে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে এরা বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউকে সেদিন মৃত্যৃর উপত্যকায় ঠেলে নামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। প্রায় ১২ বছর পরে ২০০৪-এর ২১ আগস্টের ঐ নারকীয় ঘটনা যখন ফিরে দেখি তখন স্পষ্টত মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর এই ছিল ঘৃণ্যতম নারকীয় ঘটনা। স্পষ্টত বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধী যে স্বৈরতান্ত্রিক ও নৈরাজ্যপ্রয়াসী সাম্প্রদায়িক শক্তি গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারকে দাবিয়ে নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধার করার অপপ্রয়াসে নিমগ্ন ছিল তারাই এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে সক্ষম। তাদের এই ভূমিকা জনগণের দৃষ্টির প্রকৃত ঘটনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টায় পরবর্তী পর্যায়ে মানবিক মূল্যবোধকে সরিয়ে দিয়ে এই ঘটনার লোক দেখানো বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও জজ মিয়াকেন্দ্রিক নাটকের প্রযোজক হয়েছিল। বস্তুত ২০০৪-এর ২১ আগস্টের ঘটনাবলীর তথাকথিত বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফল হিসেবে যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ঐ ঘটনা বিদেশী শক্তি কর্তৃক প্রযোজিত তখন তাকে আমরা ঐ পর্যায়ের তদন্তকে উঁচু স্তরের প্রাতিষ্ঠানিক অসততার প্রতিফলন হিসেবেই বিবেচনা করছি। এর পরে ফৌজদারি আসামি জজ মিয়ার জবানীতে এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব যখন ভিন্নতর খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা প্রযুক্ত হয়েছিল তখন তাকেও আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কর্মকা-ের ঘৃণ্যতম কলঙ্ক হিসেবে দেখতে পেয়েছি। ২১ আগস্টের এই নারকীয় ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার দেশের প্রচলিত আইনে এখন চলছে। আমরা আশা করি যে এই নারকীয় ঘটনার জন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী তাদের বাইরেও এর নারকীয়তা চাপা দেয়া বা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য যারা অপচেষ্টা চালিয়েছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেশের প্রচলিত আইনে ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্তকরণ ও সত্য গোপন বা বিকৃতি করার অপরাধে বিচারের আওতায় আনা সঙ্গত হবে। (শেষাংশ) লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×