ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের আইভী আপা

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২৪ আগস্ট ২০১৬

আমাদের আইভী আপা

আইভী রহমান। রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, নারী নেত্রী ও গৃহিণী। ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদিকা, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, মহিলা সমিতির সভানেত্রী, জাতীয় মহিলা সংস্থার সভানেত্রী এবং দীর্ঘদিন বিএনএসবির সাধারণ সম্পাদিকা। ব্যক্তিজীবনে বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী। আজ তিনি নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দেখতে দেখতে একযুগ হয়ে গেল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের মিছিল-পূর্ব সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে তিনি ঢাকা সম্মিলিত মিলিটারি হাসপাতালে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা আন্দোলন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সেবামূলক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ, নারীদের কর্মসংস্থান, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে আইভী রহমানের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৮২ সাল থেকে। তখন তিনি বিএনএসবির সাধারণ সম্পাদিকা এবং আমি একজন উর্ধতন কর্মকর্তা। তার সঙ্গে আমার কত দিনের কত স্মৃতি। তখন তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের বাসায় থাকতেন। একদিন তার বাসায় গিয়েছি। দোতলার ড্রয়িং রুমের ওয়ালে বঙ্গবন্ধুর এক বিশাল প্রতিকৃতি টানানো। বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে ছিলাম। আর মনে পড়ছিল এই মহান নেতার সঙ্গে আমার ১৯৭০ সালের এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকের কিছু ঘটনার কথা। হঠাৎ আপার কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমাকে উদ্দেশ করে আইভী আপা বলছেন, ‘আনোয়ার সাহেব ১৯৭৪ কি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে এই ছবিটি দিয়ে বলেছিলেন আইভী, এই ছবিটি তোকে দিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে এই ছবিটি কেন দিয়েছিলেনÑ আমি আজও তা জানি না।’ সেদিন আপার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা, রাজনীতির কথা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিভাবে এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বিএনএসবি গঠন করার উদ্যোগ নিলেন- সে কথা। তাদের গুলশানের বাড়িতেও যে কতদিন গিয়েছি। আমাকে স্নেহ করতেন ছোট ভাইয়ের মতো। তখন গুলশানের বাড়িটি ছিল একতলা। চতুর্দিকে খোলা জায়গা। আমগাছ ও ডালিম গাছসহ ছোট ছোট অনেক গাছপালা। সামনে পূর্ব দিকের অংশে বিশাল লন। সেখানে মাঝে মাঝে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। খুব সুন্দর লাগত বাড়িটি। পরে ঐ স্থানে সম্পূর্ণ জায়গাজুড়ে আইভী আপার জীবদ্দশায়ই নির্মিত হয় বহু তলা ভবন ‘আইভী লিগাছি’। ‘আইভী লিগাছিতে’ও আপার সঙ্গে কয়েক বার গিয়েছি। বিশাল বিশাল এক একটা রুম। ড্রয়িং, ডাইনিং, বেড। কিন্তু এখনও পূর্বের সেই একতলা খোলামেলা সুন্দর বাড়িটি সব সময় আমার চোখে ভাসে। প্রতি বছর আপার মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠিত মিলাদে গুলশানে বিশাল ‘আইভী লিগাছিতে’ যাই। কিন্তু সেই একতলা বাড়িটির সৌন্দর্য আর খুঁজে পাই না। জিল্লুর রহমান যখন মন্ত্রী হলেন তখন মন্ত্রিপাড়ার সরকারী বাড়িতে উঠলেন। হেয়ার রোডের বিশাল দোতলা বাড়ি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও মন্ত্রীর সেই বাড়িতে যেতে আমাদের জন্য কোন অনুমতি লাগত না বা ঢোকার সময় আমাদের জন্য কোন রকম চেকিংও ছিল না। কারণ আইভী আপা অনুমতি পেয়ে চেক করার পরে যারা ভিতরে ঢুকত তাদেরকে দেখেছি নিচতালায় ড্রয়িং রুমে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে। কিন্তু আমরা সরাসরি দোতলায় চলে যেতাম। কারণ আমরা আপার লোক। সেই মন্ত্রিপাড়ার বাড়িতে ঢুকে নিচতলার ড্রেয়িং রুম বামে রেখে এগিয়ে গেলে ডান দিকে মোড় ঘুরে মন্ত্রীর পিএসের রুম। তারপর মাননীয় মন্ত্রীর নিজের বসার রুম। এসব রুমের ভিতর দিয়ে যেতে হতো দোতলায় আপার রুমে। প্রায় দিনই উপরে যাওয়ার পথে মন্ত্রী মহোদয়ের বসার রুমে ঢুকে তাকে (জিল্লুর রহমান) পেয়েছি। তিনি হাসি মুখে বলতেন, ‘উপরে যাও- আইভী আছে’। সে সব স্মৃতি মনে পড়লে এখনও দু’জনের জন্যই চোখে জল আসে। জিল্লুর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি তখন বঙ্গভবনে (রাষ্ট্রপতির সরকারী ভবন) যেতাম আইভী আপার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদে। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪৪ সালে আপার জন্ম। আইভী আপা ও জিল্লুর রহমান দম্পত্তি সত্তরের দশকে গোড়ার দিকে ওয়ারীর বাসায় থাকতেন। জজ কোর্টের তৎকালীন পিপি এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন (সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি) এর পরিবার একই বাসার (উপর তলায় ও নিচ তলায়) থাকার সুবাদে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইভী রহমান ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষ ঝড়পরবঃু ভড়ৎ ঃযব ইষরহফ (ইঘঝই) গঠন করেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন সভাপতি এবং আইভী রহমান সাধারণ সম্পাদিকা। সেই থেকে (মাঝখানে কয়েক বছর বাদ দিয়ে) তারা দু’জন চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে বিএনএসবির হাল ধরেন। আইভী আপার মৃত্যুর পরও খন্দকার মাহবুব হোসেন এখন পর্যন্ত বিএনএসবি হাল ধরে আছেন আইভী রহমানের আর এক সহকর্মী খালেদা খানমসহ আরও অনেককে নিয়ে। তিনি সভাপতি ও খালেদা আপা সাধারণ সম্পাদিকা এবং লুৎফর ভাই কার্যনির্বাহী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য। আইভী রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে বিএনএসবি পরিচালিত মিরপুরস্থ ‘ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের’ মহিলা ওয়ার্ড। সেখানে বড় করে নামফলক লাগানো আছেÑ ‘আইভী রহমান মহিলা ওয়ার্ড।’ পাশেই আইভী আপার প্রতিকৃতি। আমরা প্রতি বছর আইভী আপার মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএনএসবির পক্ষ থেকে তাঁর বনানীর কবরস্থানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করি এবং বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এ বছরও আপার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে তার বিদেহী আত্মার জন্য শান্তি ও মঙ্গল কামনা করছি। লেখক : পরিচালক, বিএনএসবি ঢাকা চক্ষু হাসপাতাল
×