ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের ডিএনএ মিলে গেছে তাদের স্বজনদের সঙ্গে

হলি আর্টিজান থেকে এখনও রক্তের পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৪ আগস্ট ২০১৬

হলি আর্টিজান থেকে এখনও রক্তের পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে

শংকর কুমার দে/গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গীদের পরিচয় শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে। নিহতদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ’র নমুনা মিলে গেছে। লাশ নিতে নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে তদন্তকারী সংস্থার কাছে আবেদন করতে হবে। নতুন করে কোন নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা শেষ হওয়ার পরেই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তার আগে সম্ভব নয়। তবে হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে জঙ্গীরা উত্তেজক কোন কিছু গ্রহণ করেছিল কিনা তা এখনও জানা যায়নি। জানার চেষ্টা চলছে। এদিকে গুলশান হামলার অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে চিহ্নিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে টানা জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এই শিক্ষকের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া তাহমিদকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে গুলশান হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। গুলশান হামলার ঘটনায় হাসনাত করিম ও তাহমিদের সম্পৃক্ততা কোন পর্যায়ে তা নিশ্চিত হতে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবির পর্যালোচনা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা হাসনাত ও তাহমিদ হাসিব খানের শারীরিক ভাষারও পর্যালোচনা করছেন। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে অপরাধ বিশ্লেষকদের। সার্বিক বিশ্লেষণের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর তাহমিদকে গুলশান হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে কি হবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর এখনও স্বাভাবিক হয়নি গুলশান এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যের চিত্র। এমনকি হলি আর্টিজানসহ আশপাশের এলাকা এখনও ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। জঙ্গীদের সেদিনের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে আজও ওই এলাকার বাসিন্দারা আঁতকে ওঠেন। মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, গুলশানে জঙ্গী হামলার পর সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গীদের পরিচয় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে। হামলায় নিহত ছয় জঙ্গী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছিল। সংগৃহীত ডিএনএ’র রিপোর্ট তাদের হাতে এসেছে। রিপোর্ট মোতাবেক নিহত জঙ্গীদের পরিচয় শতভাগ নিশ্চিত হয়। পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে নিহতদের ডিএনএ পুরোপুরি মিলে গেছে। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় বনানী থানার ওসি ও ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার এবং ১৭ জন বিদেশীসহ ২২ জন নিহত হন। এরপর সেখানে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালায়। অভিযানে নিহত হয় ছয় জঙ্গী। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হামলাকারীদের একজন নিবরাস ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। আর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং মীর সামিহ মোবাশ্বের স্কলাস্টিকার ছাত্র ছিলেন। নিহত বগুড়ার ধুনট উপজেলার কৈয়াগাড়ী গ্রামের শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও শাহজাহানপুর উপজেলার খায়েরুজ্জামান মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। নিহত অপরজন শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। তিনি জঙ্গী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সাইফুল ওই বেকারির পাচক ছিলেন। তিনি হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিএমপির উপকমিশনার মাসুদুর জানান, হামলাকারী ও তাদের সহযোগিতাকারী হিসেবে চিহ্নিত সর্বমোট ছয়জনের লাশ এখনও ঢাকা সিএমএইচের মরচুয়ারিতে রয়েছে। ইতোমধ্যেই নিহত বিদেশীদের লাশ তাদের দেশে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যদিকে নিহত পাঁচ বাংলাদেশীর লাশও হস্তান্তর করা হয়েছে যার যার পরিবারের কাছে। এদিকে ঘটনার পর পরই আটককৃত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে প্রায় একমাস পর গুলশান হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আটক দেখানো হয়। পরবর্তীতে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড নেয়া হয়। হাসনাত করিমের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। হাসনাত করিমের সঙ্গে আটক করা হয় তাহমিদকে। তাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ড শেষে তাহমিদকে কারাগারে পাঠায় আদালত। তাকে গুলশান হত্যা হামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পর হাসনাত করিমকে গুলশান হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। কিন্তু তাহমিদের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তাহমিদকে গুলশান হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিভিন্ন সময় হাসনাত করিম ও তাহমিদের যে স্থির ও ভিডিও চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব ছবি অস্ত্রগোলাবারুদ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন। এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞরা সার্বিক বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে শারীরিক ভাষার বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য থাকার কথা রয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই তাহমিদকে গুলশানের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এছাড়া প্রয়োজনে তাহমিদ ও হাসনাত করিমের স্থির ও ভিডিও চিত্র বিদেশে পাঠানো হতে পারে। বিদেশী বিশেষজ্ঞদেরও প্রয়োজনে মতামত নেয়া হবে। এরপরই হাসনাত করিম ও তাহমিদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় এলাকাজুড়ে এখনও শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। অনেকটাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ময়দানের মতো। এখনও সেখান থেকে পচা রক্তের বিশ্রি দুর্গন্ধ বের হয়। বিশেষ করে প্রচ- রোদে এবং বৃষ্টির সময়ই দুর্গন্ধের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এজন্য আর্টিজানের আশপাশে সাধারণত কেউ যান না। যদিও সেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। এখনও কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। তবে কাঁটাতারের বেরিকেড সরে গেছে অনেক দূরে। আগে রেস্তরাঁটির সামনের চৌরাস্তা মোড়ে কাঁটাতারের বেরিকেড ছিল। এখন তা সরে আর্টিজানের মূল গেটের কাছাকাছি চলে গেছে। গেট থেকে প্রায় দশ ফুট সামনে কাঁটাতারের দুইটি বেরিকেড ফেলা হয়েছে। সেখানে রাইফেল হাতে পালাক্রমে পাহারায় থাকেন চারজন পুলিশ সদস্য। দেখা গেছে, আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারির মূল গেট বন্ধ। সেইসঙ্গে বন্ধ রয়েছে রেস্তরাঁটির ডানদিকে থাকা লেকভিউ ক্লিনিকটি। মূল গেটের ফাঁকা দিয়ে যে চিত্র দেখা গেছে, তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। রেস্তরাঁয় ঢুকতেই সামনে একটি প্রাইভেটকারের সামনের অংশ ধুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সেই গাড়ির সামনের অংশে চাপা পড়ে আছে কয়েকটি বাইসাইকেল। পাশেই পড়ে আছে প্লাস্টিকের চেয়ার। তা থেকে পাঁচ ছয় ফুট পেছনে লেকের দিকে আরও একটি প্রাইভেটকার পড়ে যায়। যা অনেকটাই অক্ষত। তার আশপাশে চেয়ারগুলে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সেখানে থাকা গাছের ডাল ও পাতা ঝরে পড়ে আছে। কেমন একটি বিশ্রি গন্ধ বেরুচ্ছিল। ঢুকতেই বাম দিকে হলি আর্টিজানে প্রবেশের মূল প্রবেশ গেট। সেখানে গোলাকৃতির একটি শৌখিন ছোট স্টিল ফ্রেমের তৈরি ঘর। ঘরের শুধু স্টিলের খুঁটি ও উপরের কাঠামো কোনমতে টিকে আছে। এছাড়া ঘরের দেয়ালের গায়ে ও উপরে ছাদে আর কিছুই নেই। গুলিতে তা ঝাঝরা হয়ে গেছে। সেখানে দুটি বড় আকারের সাদা ঢাকনাযুক্ত লাইটের খাঁচা ঝুলে আছে। ভেতরে বাল্ব নেই। বাল্বগুলো গুলিতে ভেঙ্গে পড়ে গেছে। লাইটের এলোমিনিয়ামের ঢাকা দুইটি গুলি চিহ্ন ধরে রেখেছে। ঘরের নিচে পড়ে আছে সিমেন্ট বালির আস্তরণ। তার বামেই সেই আলোচিত দোতলা ভবনটি। ভবনটির সামনে গুলশান লেকমুখো ছোট্ট একটি বারান্দা রয়েছে। সেখানে প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ঘরের দরজা জানালার কাঁচ, কাঠসহ সবই প্রায় গুলিতে উড়ে গেছে। ভেতরে ভবনের দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়ে আছে। ধুলো ময়লায় একাকার অবস্থা। শোভা বর্ধনের জন্য ভবনের পাশে থাকা গাছগুলো গুঁড়িয়ে গেছে। কয়েকটি গাছ মরে গেছে। আর কয়েকটি কোনমতে টিকে আছে। আর্টিজানের মূল ভবনের বাইরে থাকা সবুজ চত্বর বিবর্ণ হয়ে গেছে। অনেক দিন পরিচর্যার অভাবে ঘাসগুলো মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক জায়গায় রক্ত পড়ায় সেখানকার ঘাসগুলো মরে গেছে। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তারা সাধারণত আর্টিজানের কাছে যান না। কারণ এখনও বিশ্রি দুর্গন্ধ বের হয়। বিশেষ করে প্রচ- রোদে এবং বৃষ্টির সময়ই রক্তের পচা গন্ধ নাকে লাগে। এজন্য তারা পাশেই থাকা বাড়ির সামনে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হওয়ার কথা জানিয়েছেন আশশাশের বাড়ির বাসিন্দারা ছাড়াও বাড়িগুলোর নিরাপত্তা প্রহরীরা। সন্ধ্যা নামলেই সেখানে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। রাত যত গভীর হতে থাকে ভয়ে আশপাশের এলাকায় মানুষের যাতায়াত আরও কমে যায়। হলি আর্টিজানের আশপাশের বাসিন্দারা আজও সেদিনের জঙ্গীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। এদিকে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর ক্রেতার অভাবে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশপাশের এলাকার রেস্তরাঁ ও হোটেল ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জঙ্গী হামলার পর থেকেই এসব এলাকার ব্যবসাবাণিজ্যে ধস নেমেছে। খুচরা দোকান থেকে শুরু করে সুপারশপ পর্যন্ত এর প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের চেয়ে ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে। মূলত নিরাপত্তার অভাবে ক্রেতারা আসছেন না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পণ্যের দাম কমানোর পাশাপাশি কৌশলী ভূমিকা নিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে গুলশানের পাঁচ তারকা মানের হোটেল ওয়েস্টিনের বুকিং অর্ডার নেমে এসেছে মাত্র ১২ শতাংশে। স্বাভাবিক সময়ে এর হার ছিল ৮০ শতাংশের উপরে। কাওরানবাজারের প্যান-প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বুকিং অর্ডার আগের ৮০ ভাগের স্থলে এখন ৬০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। একই দশা হোটেল র‌্যাডিসন, লা ম্যারিডিয়ান ও লেকশোরেও। হোটেল সোনারগাঁওয়ে অতিথিদের পদচারণা ও লবিতে আড্ডার দৃশ্য চোখে পড়েনি। এ হোটেলে রুম ও স্যুটের সংখ্যা ২৭৭টি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হোটেলের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রুম ও স্যুট বুকিং হতো। সেই সঙ্গে হোটেলের ডাইনিং রুম, ঝর্ণা গ্রিল, ক্যাফে বাজার, এ্যারোমজ, লবি লাউঞ্জ, পুল ক্যাফে, ব্যালকনিভারও দেশী-বিদেশী অতিথিদের পদচারণায় সরগরম থাকত। চলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম। কিন্তু গুলশান হামলার পর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পর্যটনের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শপিং সেন্টারগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা আগের তুলনায় কম।
×