ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৬৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ব্যাংক খাতে

তিন মাসেই খেলাপীঋণ ৪ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৪ আগস্ট ২০১৬

তিন মাসেই খেলাপীঋণ ৪ হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ সুবিধায় বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়মিত করার পরও এ খাতে অস্বাভাবিকহারে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপী ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত তিন মাসেই খেলাপী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। মার্চে খেলাপী ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য নীতিমালার আলোকে ২০১৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণীকরণ করতে হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই বছরের বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। দুইয়ে মিলে ২০১৩ সাল শেষের ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও ব্যাংকগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুবিধা নিয়ে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে বেকায়দায় পড়া বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে। এসব কারণে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপী ঋণ তিন হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা কমে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপী হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শনে কিছু ঋণ নতুন করে খেলাপী করে দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা বলেন, বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপী হয়ে পড়ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমায় অনেকে দাম বাড়ার আশায় ধরে রেখে যথাসময়ে ব্যাংকের টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর বাইরে শিপব্রেকিংসহ কিছু খাত সমস্যায় থাকায় খেলাপী ঋণ বাড়ছে। তবে বছর শেষে এ পরিস্থিতি থাকবে না বলে তিনি মনে করেন। এফবিসিসিআইর সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে জ্বালানি সরবরাহ ঠিক না থাকায় অনেকে সময় মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না, এতে জাহাজীকরণ হচ্ছে দেরিতে। ফলে ডিসকাউন্ট হচ্ছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণ ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ। মার্চে খেলাপী ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ হিসাবে তিন মাসে মোট ঋণ বিতরণ ৩১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৮০ শতাংশ বাড়লেও খেলাপী ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিপুল পরিমাণ এ খেলাপী ঋণ দেশের জন্য অশনিসংকেত। কারণ, গত কয়েক বছরে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তা কখনই আদায় হবে না। খেলাপী ঋণ আদায়ে আরও বেশি কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপী হয়েছে সরকারী মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশই হচ্ছে খেলাপী ঋণ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে আগের প্রান্তিকের মতোই খেলাপী ঋণ রয়েছে ৫ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৫টি ব্যাংকে (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক) মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশই হচ্ছে খেলাপী ঋণ। তিন মাসে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ ২ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩০ হাজার ৭৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা তাদের মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ ছিল। এছাড়াও বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ হচ্ছে খেলাপী ঋণ। গত তিন মাসে খেলাপী ঋণ কমেছে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর। তিন মাসে এ খাতের খেলাপী ঋণ ১৬ কোটি টাকা কমে ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ খেলাপী ছিল, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ব্যবসায়রত বিদেশী ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ হচ্ছে খেলাপী ঋণ। আর মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপী ঋণ বেড়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, খেলাপী ঋণ বেশি হলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সুদের হারও বাড়ে। বাংলাদেশে আমানতের সুদের হার কমিয়ে এসব সমন্বয় করা হচ্ছে। খেলাপীদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার ফলে ভাল গ্রাহকদের কাছে খারাপ সংকেত যাচ্ছে। আর অবলোপন করা হচ্ছে জনগণের আমানতের অর্থ দিয়ে। এর প্রভাব পড়েছে গ্রাহকদের ওপর। এতে ভাল গ্রাহক, সৃজনশীল উদ্যোক্তারা ঋণ পেতে সমস্যায় ভোগেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে শ্রেণীকৃত ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। এর মধ্যে মন্দমানে শ্রেণীকৃত ঋণকে উদ্বেগজনক মনে করা হয়। কেননা, এ ধরনের ঋণের আদায় হয় খুব কম। এছাড়া মন্দমানের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়।
×