ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় রিও, স্বাগত টোকিও

পর্দা নামল সতেরো দিনের মহাযজ্ঞের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ আগস্ট ২০১৬

পর্দা নামল সতেরো দিনের মহাযজ্ঞের

লেজার শো’র তেলেমাতিতে স্বাগতিক শহরের আকর্ষণীয় সবকিছু যেন নেমে এলো মারাকানার মাঠে, চোখ ধাঁধানো আয়োজনে হার মানলো বৈরী আবহাওয়া। সমাপনীর আগে কাঁদলো রিও, অনুষ্ঠান শুরু ঘণ্টা দুই আগে অন্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি গর্জন। আটলান্টিকের পাহাড়সম ঢেউ আছড়ে পড়ছিল সৈকতে। গুমড়া হয়ে পড়ল আকাশ। আর কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি। আটলান্টিকের দমকা, পাগলা হাওয়া যেন উড়িয়ে নিচ্ছিল সবকিছু। আবহাওয়ার সঙ্কেত পেয়ে জনশূন্য হয়ে পড়ল নির্ঘুম কোপাকাভানা। যেখানে রাত আর দিন বলে কিছু নেই। সূর্য ডুবলেও ঘুমায় না বিকিনি খ্যাত সুন্দরীদের বিশ্ববিখ্যাত বিচ। কিন্তু সবকিছু ওলট পালট করে দিল বৈরী আবহাওয়া। সাগর, পাহাড় আর সবুজের সমারোহে অপরূপ অলিম্পিক শহর যেন ঘুমিয়ে পড়ল। প্রচ- ঘুর্ণি বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে গাছপালাগুলো হেলে পড়ছিল এদিক-ওদিক। জনশূন্য রাস্তাঘাট, সেটা কী বিদায়ের করুন চিত্র? যা অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে জানিয়ে দিল প্রকৃতি। প্রতিকূল পরিবেশে নির্ধারিত সময়েই শুরু হলো বর্ণিল সমাপনী। বিশ্বের ২০৬ দেশ, প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ক্রীড়াবিদের মহামিলনের গৌরবগাঁথা আয়োজন । বিউগলের করুন শুরে নামল অলিম্পিক পতাকা, নিভে গেল মশাল। অবশান ঘটল সতেরো দিনের ‘দ্য গেটেস্ট শো আর্থ’- মাহযজ্ঞের। বিদায় ২০১৬। স্বাগত টোকিও ২০২০। ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে রিও মেয়র অলিম্পিক পতাকা তুলে দিলেন টোকিও গবর্নরের হাতে। এখানেই শেষ নয়। স্বাগতিক ব্রাজিল বিশ্বকে দেখিয়ে দিল বর্ণিল উদ্বোধনীর মতো স্মরণ রাখা এক জমকালো সমাপনীর উজ্জ্ব¡ল মহড়া। যেখানে হার মানতে বাধ্য হলো বৃষ্টি আর ধমকা বাতাস। গ্যালারিতে তিল ধারনের উপায় নেই। আগে ভাগে টিকেট কিনে রাখা দর্শক সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন মারাকানায়, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অলিম্পিক গেমসের বর্ণাঢ্য সমাপনী উপভোগ করতে। ক্রীড়াবিদরাও পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, সৌজন্য সাক্ষাতের শেষ সুযোগটা কাজে লাগালেন মাঠে উপস্থিত হয়ে, নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা হাতে। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরাও, যারা ছিটকে গিয়েছিলেন গেমস শুরুর প্রথম ধাক্কায়। সমাপনী নামক বিষাদের অশ্রু যেন তখনও ঝরছিল আকাশ থেকে। কাক ভেজা হাজার হাজার দর্শকের সামনে মাঠেও অংশ নেয়া দেশগুলোর তারকা-মহাতারকার ভিজলেন, প্রায় তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানে। প্রকৃতির বিমাতাসুলভ আচরণের মাঝে হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন সবাই মন খোলা হাসির রেখা টেনে। প্রায় সবার গায়ে ওয়ানটাইম, পাতলা পলিথিনের জ্যাকেটে। যাকে খাঁটি বাংলায় রেইন কোট বলা হয়। যান্দ্রিক বিমানের প্রথম ফ্লাইট চালু করার আবিস্কারক স্যান্টোস ডুমন্ট। ব্রাজিলের গর্ব ডুমন্ট ৮টা বিশ মিনিটে ঘড়িতে চোখ রেখে প্রথম যাত্রীবাহী বিমাান চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় শত বছর আগের স্মরণীয় সেই মুহূর্ত ফের দেখিয়ে দিল রিও। ইতিহাস হয়ে থাকা সময়টা অনুস্মরণ করে শুরু হয় সমাপনী। স্যান্টোর ডুমন্টের নামে রিওতে বিমানবন্দর রয়েছে। লেজার শোর মাধ্যমে সেটাই প্রদর্শিত হলো মূল অনুষ্ঠানে। তার আগে, সঙ্গীত, ব্যান্ড, আর সাম্বা নৃত্য মাতিয়ে রাখে দর্শক। সমাপনী অনুষ্ঠান শুরুর প্রায় দুই ঘণ্টা আগে মারাকানার গ্যালারি শোভিত হয়ে উঠে ক্রীড়াপ্রেমী দর্শকের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম অলিম্পিকে ব্রাজিল দেখিয়ে দিল তারা কেবল ফুটবলের দেশ নয়। সফল অলিম্পিক আয়োজনেও পারঙ্গম। সমাপনীতে কেবল বিষাদের সুরই বাজল না। নাচ-গান অর রঙের বর্ণময় পসরা সাজিয়ে সেটিকে করে তোলা হলো সত্যিকার এক মহাউদযাপনে। অলিম্পিকের জয়গান। বিশ্বমানবতার জয়গান। আলোর ঝলকানি, তেলেসমাতিতে বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়া হলো রিও শহরের বিখ্যাত সব স্থাপনা, ক্রাইস্ট দ্য রিদিমার, সুগারলোফ, লাপা আর্চ সবই। ব্রাজিল ... ইটস এ বিউটিফুল কান্ট্রি’-জনপ্রিয় গানটির বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলো। আসলেই ব্রাজিল যে সুসজ্জিত, দেখার মতোই একটি দেশ। যা রিও অলিম্পিকের সমাপনীতে দেখানো হলো, যা নিয়ে গর্ব করতেই পারে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ কোটি মানুষের এই দেশ। অনেক কিছুই বিশেষত্ব আছে ব্রাজিলের। ক্রীড়া,সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সবকিছুতে। এক কথায় উৎসব প্রিয়তার গর্ব করার সবকিছুই রয়েছে এখানে। আর সবকিছুই যেন এক সুতোয় গেঁথে আলোর রোশনাইয়ে একত্রিত করা হলো মারকানার মাঠে। সব কিছুরই খ- খ- সংস্করণ দেখা গেল সমাপনীর উদযাপনে। গেমসের প্রাণভোমরা ক্রীড়াবিদরা একে একে মাঠে প্রবেশ করলেন ‘হিরোস অব দ্য অলিম্পিক’ পর্বে। উদ্বোধনীর মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা এবার চোখে পড়েনি। মাঠের চারপাশে সাজিয়ে রাখা বৃত্তাকার চেয়ারে বসে দেখলেন সবাই রিওর আকর্ষণীয় সব উজ্জ্বল উপস্থাপনা। বক্তৃতা পর্বে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান টমাস বাখ তো বলেই ফেললেন, এসেছিলাম দর্শক হয়ে। আর ফিরে গেলাম বন্ধু হিসেবে। এখানেই অলিম্পিক গেমসের স্বার্থকতা। সৌহার্দ আর ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধনে গোটা বিশ্বকে এক করে দেয়া। যেখানে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে। কেবল খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্বকে একটি জগতে পরিণত করার অন্যতম বড় মঞ্চ তাই অলিম্পিক। অনুষ্ঠানে আয়োজক ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টসহ উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের অনেক দেশের নেতৃবৃন্দ। যেখানে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজু আবেই। জাদুর মঞ্চে জাদুকর যেভাবে বক্সে করে জীবন্ত মানুষকে টুকরো টুকরো করা ভেল্কি দেখিয়ে থাকেন সেভাবেই বক্সের ভেতর থেকে হঠাৎ লাল রঙের বল হাতে বেরিয়ে পড়লেন স্যুটেট-বুটেট সিনজু। আবার পরক্ষণেই হওয়া। বাহারি রঙের আলোর ঝলকানিতে মিলিয়ে গেলেন তিনি। সেটার একটা কারণ আছে। পরবর্তী অলিম্পিক গেমসের আয়োজন জাপান। সমাপনী অনুষ্ঠানের মাঝ খানে একটা অংশ রাখা হয়েছিল স্বাগতিক শহর টোকিও জন্য। এটাই নিয়ম। চার বছর পর জাপানের রাজধানীতে বসবে বিশ্ব ক্রীড়ার সবচেয়ে বড় আসর অলিম্পিক গেমসের মিলন মেলা। সেখানে যে খেলাগুলো হবে সেগুলোর অপরূপ এক প্রদর্শনীতে জাপানীরা মনে করিয়ে দিল প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের গাঁটছড়ার কথা। রিও কার্নিভাল বিশ্ববিখ্যাত। সেটি দিয়েই শেষ করা হলো অনুষ্ঠান। সতেরো দিনের মহামিলনে পদকের লড়াইয়ে দেখা গেছে পাওয়া না পাওয়ার কান্না। সাফল্য-ব্যর্থতার চিত্র। সব হিসাব চুকে গেল রিওতে, রবিবার রাতে। আতশবাজির ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠল রিওর আকাশ। মারাকানা বনে গেল আলোর ঝর্ণ ধারায়।
×