ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবার দেখা হবে টোকিওতে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য

আলোর ঝর্ণাধারায় পর্দা নামল রিও অলিম্পিক গেমসের

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৩ আগস্ট ২০১৬

আলোর ঝর্ণাধারায় পর্দা নামল রিও অলিম্পিক গেমসের

সতেরো দিনের মহাযজ্ঞ শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। যাবতীয় আশঙ্কা, সীমাহীন উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার বলয়ে পর্দা উঠেছিল রিও অলিম্পিক গেমসের। সোমবার বাংলাদেশ সময় ভোরে যখন রিওর ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা হলো গেমসের, একটা কথা বলা যেতেই পারে, হাফ ছেড়ে বাঁচল ব্রাজিলীয়রা। আশঙ্কা আর উদ্বেগ নির্মূল করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো’-সফল, ত্রুটিহীন আয়োজন করে রিও দেখিয়ে দিল ঘরে-বাইরে যত সমস্যা থাকুক, সবকিছু হার মানানো যায় আন্তরিকতা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে। অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি টমাস বাখ যখন বললেন, অনবদ্য শহরে এটি ছিল এক অনবদ্য গেমস। তখন গর্বে যেন বুকটা ভরে যায় ব্রাজিলীয়ানদের। গ্যালারি ভর্তি দর্শকের করতালিতে মুখরিত হয়ে পড়ে গোটা স্টেডিয়াম। তিনিই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তার আগে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মারাকানায় উপস্থিত দর্শকের মন ভরিয়ে দেয়। টিভির পর্দায় হয় তো বিশ্বাসীও যা মন ভরে উপভোগ করলেন। অনুষ্ঠানে কত যে রং, স্মরণীয় সব মুহূর্ত। খেলা ভালবাসেন তাদের কাছে তো বটেই। এমনকি খেলাধুলায় তেমন উৎসাহ নেই এমন লোকদেরও মাঝিয়ে দেয়ার মতো বর্ণিল এক আয়োজন দেখিয়ে দিল রিও। ব্রাজিল গোটা বিশ্বের কাছে ফুটবলের দেশ হিসেবে যদি পরিচিত হয়ে থাকে, তবে পরের কারণটা অবশ্যই সে দেশের অনুপম ছন্দের সাম্বা নৃত্যের জন্য। গেমসের সমাপনীতে তাই অবধারিতভাবে সাম্বাও রইল। তবে আলোর রং মসাল আর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের মাঝে হৃদয় নিংড়ানো আবেগও হয়ে উঠল মূর্ত মনোরম লেজার শো’র বদৌলতে। যা আলোকিত করে রাখে গোটা অনুষ্ঠান। আর ফায়ার ওয়াক্স, তথা আতশবাজির ঝলকে নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠা রিওর আকাশের অপূর্ব দৃশ্য ছিল চোখ জুড়ানো। মারাকানার এ রাত দেখল বৃষ্টির ঝর্ণাধারা আর চোখের জলও। সেটা আর তখন পদক লড়াইয়ে হার জিতের নয়। কেবলই বিদায়ের। সে উদযাপনে মিলনমেলা ভাঙ্কার করুন সুরে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি মাঠে উপস্থিত বিশ্বের ২০৬ দেশের হাজার হাজার ক্রীড়াবিদ। অলিম্পিক এক অর্থে বিশ্বক্রীড়ার সর্বোত্তম মঞ্চ। এমন এক মঞ্চ যেখানে দাঁড়িয়ে পড়াটাই অনেকের কাছে আজন্মলালিত স্বপ্ন। খেলার মাঠের সাফল্য, ব্যর্থতা, আলো, অন্ধকার, হতাশা-বিষাদের উচ্ছ্বাস-এমন অনুভূতিকে ছাপিয়ে অলিম্পিকই এক অর্থে বিশ্ব ক্রীড়ার সেরা মঞ্চ। এমন এক আসরের পর্দা নেমে গেল মানে কোথাও কিছু হারিয়ে ফেলার বিষন্ন অনুভূতি। আবার চার বছর পর দেখা হবে টোকিওতে। রিওর মন মাতানো অনুষ্ঠানে টোকিওর গবর্নর ইউরিকো কোইকে অলিম্পিক পতাকা গ্রহণ করলেন টমাস বাখ রিওর মেয়র এডুয়ার্ডো পেজের কাছ থেকে। মারাকনায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করলেন সাড়া জাগিয়ে। মাঠে তিনি বেরিয়ে এলেন লাল বল হাতে বিষেশভাবে তৈরি এক বক্স থেকে। লেজার শো’র ঝলকানিতে আবার হারিয়েও গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যে। রিওর শেষ মাদল বাজামানে সূর্যোদয়ের দেশে সূচনার কলতান। সেই ১৯৬০ সালের পর ফের জাপানে বসতে চলেছে অলিম্পিকের আসর। ঠিক আজ থেকেই তাদের গুছিয়ে নেয়ার পালা শুরু হলো। যদিও টোকিওর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকল তারকাশূন্যতা। অলিম্পিক গেমসে দ্যুতি ছড়িয়ে বিশ্ব ক্রীড়ার অবিসংবাদিত সম্রাট বনে যাওয়া উসাইন বোল্ট আর মাইকেল ফেলপসকে পাচ্ছে না জাপান। রিওর আগে বিগত দুই আসরের এ দুই মহানায়কই ছিলেন রিও অলিম্পিকের আকর্ষণের কেন্দ্রে। আর দু’জনে এক সঙ্গে বিদায় নিয়ে নিলেন রিওতে। মানে অলিম্পিকে আর খেলবেন না যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সাঁতারু ফেলপস ও জ্যামাইকার গতির রাজা বোল্ট। যাদের খেলা দেখতে বিশ্ব থেকে ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ভিড় করতেন আয়োজক শহরে। ফেলপস আর বোল্টের কীর্তি গড়ার মতো কোন তারকা থাকছেন না টোকিওতে। এটা জাপানের জন্য নিঃসন্দেহে চিন্তার। এক কথায় গ্ল্যামারহীন হয়ে পড়তে বাধ্য টোকিও অলিম্পিক। এদিকে যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে সমাপ্তি ঘটল রিও গেমসের। মোট ১২১ পদকের মধ্যে স্বর্ণ ৪৬, রৌপ্য ৩৭ আর ৩৮ ব্রোঞ্জ নিয়ে শীর্ষে ফেলপসের দেশ। দ্বিতীয়স্থানে থাকা চীনের মোট ৭০ পদেকে স্বর্ণ ২৬, রৌপ্য ১৮ ও ২৬ ব্রোঞ্জ। তৃতীয় স্থানে থাকা ব্রিটেনের স্বর্ণপদক ২৭। রৌপ্য ২৩ আর ব্রোঞ্জ ১৭ মিলিয়ে মোট ৬৭। পরেই রাশিয়া। ডোপ কেলেঙ্কারিতে ভাঙ্গাচুরা দল নিয়েও জিতে গেঝে ৫৬ পদক। তাতে স্বর্ণ ১৯, রৌপ্য ১৮ ও ১৯ ব্রোঞ্জ। যা নিয়ে গর্ব করতে পারে দেশটি। আর জার্মানির মোট ৪২ পদকে ১৭ স্বর্ণ, ১০ রৌপ্য ১৫ ব্রোঞ্জ। রিও গেমসের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্তে হচ্ছে উসাইন বোল্টের ‘ট্রিপল-ট্রিপল’ স্বপ্ন পূরণ। বেজিং, লন্ডন হয়ে রিও- টানা আসরে মোট ৯ স্বর্ণপদক গলায় ঝুলিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে গেছেন তিনি। যদিও পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। কিন্তু তার এই রেকর্ড কে কবে ভাঙবে সেটাই দেখার। ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে টানা তিন অলিম্পিক স্বর্ণ। আর দলগত ৪ল্প১০০ মিটার রিলেতে জ্যামাইকা দলের স্বর্ণ অক্ষত থাকায় রেকর্ড হয়ে গেল বোল্টের গৌরবময় অর্জন। সাঁতারে মাইকেল ফেলপসের মোট ২৩ অলিম্পিক স্বর্ণপদকের মধ্যে পাঁচ জয় করেছেন এবার রিওত। দ্রুততম মানব বোল্টের স্বদেশী এ্যালেইন টম্পসন দ্রুততম মানবী হয়ে রানীর নতুন আসনে। এছাড়া নারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বিখ্যাত সাঁতারু কেট লিডেকি রিওতে পাঁচ স্বর্ণপদক গলায় ঝুলিয়ে নিজের রেকর্ড আরও সুবিন্যস্ত করে নিয়েছেন। ব্রিটেনের দূরপাল্লার দৌড়বিদ মো ফারার ‘ডাবল’ স্বর্ণ জয় ঠাঁই পেয়েছে আলোচনায়। রিদমিক জিমন্যাস্টিক্সে রাশিয়ার হয়ে স্বর্ণপদক জয় করা মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো গর্ব করতে পারে বাংলাদেশ। তার বাঙালী বাবা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি রাজশাহীতে। যার সুযোগ্য কন্যা মার্গরিটার রয়েছে সবুজ বাংলাদেশী পাসপোর্ট। তবে রাশিয়ার নাগরিক তিনি। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া সাত ক্রীড়াবিদের কাহিনী নতুন আর লেখার কিছু নেই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও একই আওয়াজ ‘পদক নয়-অভিজ্ঞতা অর্জন আর অংশগ্রহণই মূল কথা।
×