ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি

মরা পদ্মায় বান ডেকেছে শরতে পালতোলা নৌকায় ঢেউয়ের নাচন

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৩ আগস্ট ২০১৬

মরা পদ্মায় বান ডেকেছে শরতে পালতোলা নৌকায় ঢেউয়ের নাচন

মামুন-অর-রশিদ ॥ পদ্মায় ঢেউয়ের নাচনের কথা মানুষ যেন ভুলতেই বসেছিল। তবে এবার স্বরূপে ফিরেছে এ নদী। এখন আবার পদ্মা সেই উদ্ভিন্ন যৌবনা। ভাদ্রে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে এককালের প্রমত্তা পদ্মা। শরতের শুভ্র মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরিতে স্রোতস্বিনী পদ্মা এবার দেখা দিয়েছে নিজ রূপে। দীর্ঘদিন পর পদ্মার বুকে এখন পালতোলা আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলের মুগ্ধ দৃশ্য। প্রাণ পেয়েছেন ঝিমিয়ে পড়া পদ্মাপারের জেলে-মাঝিরা। উজান থেকে ধেয়ে আসা স্রোত আর ঢেউ মনে করিয়ে দিচ্ছে কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সুরÑ পদ্মার ঢেউ রে...। কবির সেই গানে কণ্ঠ মিলিয়ে এখন পুলকিত পদ্মাপারের মানুষ। এ কূল ভাঙ্গা আর ও কূল গড়ার পদ্মা শহর অংশে ফিরে এসেছে চির যৌবনের উচ্ছ্বাস, ঠিক তেমনই সর্বনাশী রূপ নেয়ায় হাহাকার নেমেছে ওপারে চরাঞ্চলে। পদ্মার উদ্দাম স্রোতের নাচন দেখতে রাজশাহীতে এবার সকাল দুপুর সন্ধ্যায় ভিড় জমাচ্ছেন মানুষ। বোলনপুর ঘাট থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত ১০ কিমিজুড়ে এখন মানুষের ভিড়। টাইলসের কারুকাজ করা নদীপাড় ঘিরে বেড়েছে আনাগোনা। পদ্মাপারের বাসিন্দারা জানান, এবার মাঝবর্ষা থেকেই পদ্মা আসল চেহারায় ফিরেছে। নৌকা চলছে স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, মাঝিরা চরম ব্যস্ত যাত্রী পারাপার নিয়ে। জেলেরাও মাছ ধরে জীবিকার উৎস খুঁজে পেয়েছেন। স্রোতের কলকলানি দোলা দিয়েছে মনেও। রবিবার পদ্মাপাড়ে গিয়ে দেখা যায় সর্বত্র কোলাহল। চিরযৌবনা পদ্মা দেখতে সব বয়সী মানুষের জটলা। কেউ কেউ নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছেন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে। স্থানীয়রা জানান, বছর ঘুরে পদ্মায় আবার বান ডেকেছে। চঞ্চলা আর দুরন্ত হয়ে ছুটে চলছে উথাল-পাথাল ঢেউ। দিনে নদীর টলমল পানির মাঝে ছোট ছোট ঢেউ। তার ওপর নেচে বেড়াচ্ছে সূর্যের আলো। রাতের জোছনায় থৈ থৈ নদীর চারপাশÑ বহুদিন পর স্বরূপে ফিরেছে উত্তাল পদ্মা। এ বছর বর্ষা শুরুর প্রথমদিকেও পদ্মা ছিল খালের মতো। বৃষ্টি না হওয়ায় আষাঢ়েও পানি ছিল না। তবে শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে পদ্মায় পানি আসতে শুরু করে। বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মা ফিরে পায় তার যৌবন। আর এতেই খুশি রাজশাহীর পদ্মাতীরের মানুষ। এখন ভরা বর্ষায় পদ্মায় নৌকা ভাসছে। সকাল-বিকেল বিনোদনপ্রেমীরা ভিড় করছেন নদীর ঘাটে। দল বেঁধে ঘণ্টা চুক্তিতে নৌভ্রমণে ছুটছেন। বড়কুঠি ঘাটে বেড়াতে আসা রাবি শিক্ষার্থী জোবাইদা জ্যোতি, গোলাম নবী, রাজশাহী কলেজের ছাত্রী যুথি শারমিন বলেন, কেবল এ সময়টাতেই পদ্মায় পানি থাকে। অন্য সময় চর। তবে চরে বেড়ানোর চেয়ে নৌকা ভ্রমণের আনন্দ বেশি। তাই নির্মল বাতাসে নদীরবুকে নৌকায় বেড়ানোর জন্য তারা মাঝে মধ্যেই দল বেঁধে আসেন পদ্মায়। মাঝবয়সী মাঝি ইসাহাক আলী বলেন, নৌকার ভাড়া পেয়ে তার মতো মৌসুমী মাঝিরা এখন খুশি। কেউ ঘণ্টা চুক্তিতে আবার কেউ জনপ্রতি ভাড়া দিয়ে নৌভ্রমণ করেন। এখানে কোন ভাড়া নির্দিষ্ট নেই। যার কাছে যেমন পাওয়া যায়। তবে সাধারণত দেড় থেকে ২শ’ টাকা ঘণ্টা চুক্তি পেলেই তারা খুশি। এর কম-বেশিও হয়। পদ্মা তীরবর্তী ফুদকিপাড়ার পাপ্পু সরকার জানান, কেবল বর্ষায় মৌসুমী জেলেরা পদ্মায় মাছ ধরেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের প্রথমদিকে পানি না থাকায় তারা হতাশ হন। এবার শ্রাবণের শুরুতে নদীতে পানি আসায় তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। রাজশাহীর সবকিছুই যেন এখন পদ্মা ঘিরে। গ্রীষ্ম, শীত, বর্ষা কিংবা শরত সব ঋতুতেই সব সময় পদ্মানদীকে ঘিরেই মানুষের আনাগোনা। গ্রীষ্মে শুকিয়ে কাঠ হওয়া পদ্মা আর বর্ষায় টইটম্বুর সব সময় মানুষকে কাছে টানে। নিয়ে যায় এক অনন্য নিসর্গে। পদ্মানদীর তীর ঘেঁষে ব্যবসা বাণিজ্যও জমে উঠেছে। সারাদিন মানুষের আনাগোনায় মুখর নদীপারে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বাণিজ্যকেন্দ্র। বুলনপুর এলাকায় ‘আড্ডা’ সেখান থেকে পেরিয়ে সামান্য এগোলেই চোখে পড়বে ‘টি-বাঁধ’। আরও একটু পরে ছোট পরিসরে পার্ক তৈরি করেছে বর্ডার গার্ড বিজিবি। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বহির্নোঙ্গর’ আর ‘সীমান্তনোঙ্গর’। সবধরনের হাল্কা খাবার মেলে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট আমবাগানের ফাঁকে ফাঁকে বাসার সুরম্য স্থান। সেখানে বসে অনায়াসে নদীর সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। এখানে নদী ভ্রমণে আগ্রহীদের জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে ‘গাঙচিল’ নামের ছোট আকারের নৌকা। রাতের আঁধারে রঙিন নিয়ন আলোয় আরও ঝলমলে হয়ে উঠে এ স্পটের চেহারা। রাজশাহীতে হাতেগোনা কয়েকটি বিনোদন স্পট থাকায় মানুষের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে এই পদ্মারপাড়। পদ্মারপাড়ে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা আর তাদের মুগ্ধ করছে প্রমত্তা পদ্মা।
×