ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

-আরিয়ানা হাফিংটন

যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি এই প্রজন্মই দূর করতে পারবে ...

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৩ আগস্ট ২০১৬

যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি  এই প্রজন্মই দূর করতে পারবে ...

-সুমন্ত গুপ্ত বিশ্বের গণমাধ্যমে আরিয়ানা এক নামেই বিখ্যাত। পুরো নাম আরিয়ানা হাফিংটন। জন্ম ১৫ জুলাই, ১৯৫০। গ্রীসে জন্ম নেয়া বহুল আলোচিত আরিয়ানা এখন বিশ্বের জনপ্রিয় অনলাইন মিডিয়া হাফিংটন পোস্টের প্রধান উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক। ব্যক্তি হিসেবে তিনি লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আরিয়ানা পড়াশোনার জন্য ব্রিটেনে চলে আসেন। পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। আরিয়ানা ক্যামব্রিজ ইউনিয়নের প্রথম বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে সুপরিচিত করে তোলেন। এরপর ১৯৭১ সালে গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন আরিয়ানা। সে সময়ের জনপ্রিয় সাংবাদিক বার্নার্ড লেভিনের কারণে গান লেখার প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। লেভিনের নির্দেশনায় গান নিয়েই লেখালেখিতে তার হাতেখড়ি। নিজে একসময়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামী মাইকেল হাফিংটনও ছিলেন রাজনীতিতে। পরে যুক্ত হয়ে যান লেখালেখির সঙ্গে। নিয়মিত কলাম লিখতে থাকেন। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে নিজের জনপ্রিয় সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য হাফিংটন পোস্টের মাধ্যমে বেশি পরিচিতি পান আরিয়ানা হাফিংটন। ২০১১ সালে দ্য হাফিংটন পোস্টকে অধিগ্রহণ করে আমেরিকান অনলাইন লিমিটেড (এওএল) এবং আরিয়ানা হাফিংটন পোস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রেসিডেন্ট এবং এডিটর-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু“করেন। বর্তমানে এ মিডিয়া গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত আছে ইএনগ্যাজেট, এওএল মিউজিকসহ আরও কয়েকটি সেবা। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভু গির্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। এ কলেজের ক্যামব্রিজ ইউনিয়নে প্রথম বিদেশি এবং তৃতীয় নারী প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি। উদ্যোক্তা হিসেবেও সফল আরিয়ানা। নিয়মিত কাজের পাশাপাশি কলাম লেখা, বই লেখার কাজটিও করে যাচ্ছেন তিনি। নারী ক্ষমতায়নে বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন এখনও। দুই কন্যার জননী আরিয়ানা পেয়েছেন একাধিক স্বীকৃতি। ২০০৯ সালে বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের করা মিডিয়ায় কাজ করা সেরা উদ্যমী নারীর মধ্যে জায়গা করে নেন তিনি। এছাড়া ২০১৩ সালের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী উদ্যোক্তার তালিকায়ও আছে তাঁর নাম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য হাফিংটন পোস্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক আরিয়ানা হাফিংটন। ফোর্বস সাময়িকীর করা তালিকা অনুযায়ী, তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নারী। ২২ মে ২০১৬ যুক্তরাষ্ট্রের কলবি কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তা ছিলেন এই কলাম লেখক ও ব্যবসায়ী তার কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো- আজকের দিনটা অদ্ভুত বৈপরীত্যের। দুটো জীবনের আলো আজ তোমাদের গায়ে এসে পড়ছে। একটা জীবন শেষ হচ্ছে, আরেকটার আজ শুরু। যে জীবনটা তোমরা এখানে ছেড়ে যাচ্ছ, সেটার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, এটা ছিল সাজানো। এই জীবনের মূল কথাÑ জ্ঞান হলো মনের আলো। কিন্তু যে জীবনে তোমরা প্রবেশ করছ, সেটা একেবারেই অন্য রকম বিশৃঙ্খল, বিভ্রান্তিতে ভরপুর; অসংখ্য তথ্যের মধ্যে ডুবতে বসা একটা পৃথিবী। জ্ঞান যদি হয় মনের আলো, তাহলে আমার মতে, সত্য সব সময় কুয়াশায় ঢাকা। তোমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ এখন এটাই কুয়াশা সরিয়ে সঠিক পথটা খুঁজে বের করা। আর তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটাও জেনে রাখ। তোমার কাজ শুধু পৃথিবী জয় করা নয়, পৃথিবী বদলানো! এমন একটা পৃথিবীতে তোমরা প্রবেশ করছ, যেখানে সাফল্যের জন্য তোমাকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে। হতাশা, মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই করে যথেষ্ট ঘাম ঝরানোর পর মিলবে বিজয়ের দেখা। আমি বিশ্বাস করি, যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি একটা প্রজন্মই দূর করতে পারে। মাঝেমধ্যে আমরা এমন একটা বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠি, যেটা একেবারেই মিথ্যে। যেমন একটা সময় মনে করা হতো ধূমপান করা এক রকম ‘স্মার্টনেস’, আভিজাত্যের চিহ্ন! আমার মনে হয়, এখন তোমাদের ‘কম ঘুমানোর’ ক্ষতিকর দিকগুলো জানার সময় এসেছে। ধূমপানের কুফল বুঝতে আমাদের প্রজন্মের সময় লেগেছিল। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে তোমরা আর দেরি করবে না। কলেজ জীবনে কম ঘুমাতে হবে, এটাই তোমরা রীতিমতো অবধারিত বলে ধরে নিয়েছ। এমন একটা সেøাগানও প্রচলিত আছে : ঘুম, গ্রেড, সামাজিক জীবন- যে কোন দুইটা বেছে নাও! আমেরিকার অনেক ক্যাম্পাসেই এ ধরনের কথা শোনা যায়। ব্যাপারটা এমন, যেন কলেজপড়ুয়াদের ঘুম আর জীবন, দুটো থেকে যে কোন একটা বেছে নিতে হবে। আর তাই ‘হাফপোস্ট সিøপ রেভ্যুলিউশন ট্যুর’-এ আমরা দেশের ৩০০ কলেজে যাচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য, মানুষকে ঘুমের গুরুত্ব বোঝানো। অনেক অফিসে সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করাকে বাহবা দেয়া হয়। অথচ ব্যাপারটা মদ্যপ হয়ে অফিস করাকে স্বাগত জানানোর মতো! বিজ্ঞান বলছে, কর্মক্ষেত্রে ভাল পারফরম্যান্সের জন্য যা কিছু লাগে- সৃষ্টিশীলতা, কার্যক্ষমতা, সমস্যা সমাধান বা মানসিক চাপ সামলানোর ক্ষমতা, সবার সঙ্গে মিলে কাজ করার ও শেখার দক্ষতা; ঘুম এর সবগুলোকে প্রভাবিত করে। ভাল ঘুম হলে এসব বাড়বে, ভাল ঘুম না হলে কমবে। নিজেকে ‘আনপ্লাগ’ করা এবং ‘রিচার্জ’ করার মতো নিয়মানুবর্তিতা মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। যে মানুষ নিজেকে সারা দিন ই-মেইলের ইনবক্সের সঙ্গে বেঁধে রাখে, তাকে নয়; বরং যে আনন্দ নিয়ে কাজ করে, যার মধ্যে কল্পনাশক্তি আর উদ্যম আছে, তাকেই কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি দেয়া উচিত। যিনি দম্ভ করে বলেন, আমি দিনে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাই, তাঁর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে, তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে থাকেন! যেমন রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পাওয়া লোকটি তাঁর চার ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস নিয়ে গর্ব করেন। আমরা একটু ভেবে দেখি, এই চার ঘণ্টায় তিনি যদি তাঁর মোবাইল ফোনটা পাশে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁর মানসিকতায় কী কী প্রভাব পড়তে পারেÑ তথ্য যাচাইয়ে অক্ষমতা, মানসিক অস্থিরতা, যখন-তখন রেগে যাওয়া, স্মৃতি দ্বারা প্রতারিত হওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, বিবাদ করার প্রবণতা তৈরি হওয়া...ইত্যাদি। এর সবই কম ঘুমের ফল। অতএব প্রেসিডেন্ট হওয়া অথবা একটা সাধারণ চাকরিতে যোগ দেওয়াÑ যে দৌড়েই তুমি থাকো না কেন, ঘুম তোমার কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ। এবং এই ওষুধের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। একটা ছোট্ট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করলে কেমন হয়? আমি বলি কিÑ এ্যালার্ম ছাড়া ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করো। সতর্কতা হিসেবে তুমি এ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারো। কিন্তু একটা পুরো রাত ঘুমানোর পর আসলে স্বাভাবিকভাবেই তোমার ঘুম ভাঙ্গা উচিত। জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ভেবে দেখ, ‘এ্যালার্ম’ শব্দটার মানে কী? হঠাৎ কোন বিপদ বা দুর্ঘটনার সময় একটা সংকেত, যেটা কোন দুঃসংবাদের আভাস দেয়। অর্থাৎ ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহে একটা মানসিক চাপের হরমোন তৈরি হয় আর এ্যাড্রেনালিন হ্রাস হতে থাকে। কারণ, এ্যালামের শব্দ পেয়েই বিপদের জন্য শরীর আমাদের তৈরি করে ফেলে।
×