ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ফিরে দেখা ২১ আগস্ট, ২০০৪

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৩ আগস্ট ২০১৬

ফিরে দেখা  ২১ আগস্ট, ২০০৪

(গতকালের পর) দেখলাম রক্তমাখা শরীর নিয়ে শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু, মেয়র হানিফ, সাহারা খাতুন, হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্রাক থেকে নেমে যাচ্ছেন। তাদের পেছনে সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ট্রাক থেকে পা টানতে টানতে নেমে গেলেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য জিল্লুর রহমান ঘটনার শকে নিশ্চুপ নিথরভাবে ট্রাক-ডেকে শুয়ে পড়েছিলেন। তাকে কয়েকজন দলীয় কর্মী ট্রাক থেকে তুলে নামিয়ে নিয়ে যান। আমার ঠিক পেছনে সারা শরীরে রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ। তিনি আমাকে বললেন, আমি আহত, আমাকে ছেড়ে যাবেন না। কয়েকজন দলীয় কর্মীর সহায়তায় তাকে আমি ট্রাক থেকে নামিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে ঢুকলাম। ঢোকার পথে জনতার প্রচ- চাপে আমরা প্রায় পদপিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। জনতার এই চাপ এসেছিল পুলিশ বাইরে লাঠিচার্জ করছিল ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ছিল বলে। টিয়ারগ্যাসশেল ছোড়ার শব্দের মাঝে পিস্তলের গুলির আওয়াজও শুনেছি মনে হলো। দেখলাম কেন্দ্রীয় অফিসের নিচতলায় রক্তে ভেজা জামা-কাপড় গায়ে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, মেয়র হানিফ ও আরও অনেকে। তিল ধারণের জায়গা নেই। আমি কাজী জাফরউল্লাহকে কয়েকজন কর্মীর সহায়তায় টেনে ধরে তৃতীয় তলায় উঠালাম। দ্বিতীয় তলার কামরাগুলো তালাবন্ধ ছিল। এ কামরাগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত শাহজাহানকে কোথাও পেলাম না। পরে শাহজাহানকে মিরপুরের সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে স্পিøন্টারে আহত আবস্থায় দেখতে পাই। তিনতলায় আমি কাজী জাফরউল্লাহকে একটি বেঞ্চির ওপর শুইয়ে দিয়ে দেখি তার পালস দুর্বল। তার শরীরের বাঁদিক রক্তে ভেজা। তিনি তার বাম হাতে প্রচ- ব্যথা হচ্ছে বললেন। বললেন তার চোখের দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। আমি এ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করার জন্য নিচে দৌড়ে নেমে আসি। এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে আমি তিনতলার ছাদে দৌড়ে উঠলাম চারদিক দেখব বলে। দেখলাম উত্তরদিকে জিপিও বরাবর কু-লী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। তারপর পূর্বদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলামÑ রাজ্জাকস নামীয় দোকান সংবলিত ইমারতের ছাদের ওপর পুলিশের খাকি শার্ট ও নিচে লুঙ্গি পরিহিত তিনজন রাইফেলধারী লোক দাঁড়িয়ে। একজন দলীয় কর্মী চিৎকার করে আমাকে তখুনি সরে যেতে বললেন। আমি দৌড়ে তিনতলায় কাজী জাফরউল্লাহর পাশে চলে এলাম। এই সময় প্রায় ৬টা ২০মি: তখন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী দৌড়ে ওপরে উঠে আসলেন। সাবের হোসেন ও মতিয়া চৌধুরী, শেখ হাসিনা যে মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন বলে এসেছিলেন, তার আগের দিকে সমাবেশকে নূর হোসেন চত্বরের কাছে সংগঠিত করেছিলেন। সেজন্য গ্রেনেড হামলায় তারা আঘাত পাননি বা আহত হননি। তিনি বললেন, গ্রেনেড হামলা থামার পর তিনি কেন্দ্রীয় অফিসে ছুটে এসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও অন্য নেতাদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মোবাইল ফোন ও লোক মারফত আমরা কাজী জাফরউল্লাহর জন্য এ্যাম্বুলেন্স আনতে চেষ্টা করলাম। বিফল হয়ে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কিছু না কিছু একটা যোগাড় করা যাবে বলে আমরা তাকে নিচে নামিয়ে আনলাম। এদিক ওদিক দৌড়ে একটি রিক্সাভ্যান যোগাড় করে তাকে মাঝখানে বসিয়ে একদিকে আমি আর একদিকে সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে সচিবালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) একটি চৌকস দলকে মোতায়েন দেখলাম। ওসমানী মিলনায়তনের কাছে একটি গাড়ি পেয়ে কাজী জাফরউল্লাহকে তাতে উঠিয়ে আমি আর সাবের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দিকে ছুটলাম। বাংলাদেশ রাইফেলের ঐ দলকে সচিবালয়ের মোড়ে মোতায়েন দেখে আমাদের বড় বেখাপ্পা লাগল। আগে থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তৈরি না রাখলে গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এত অল্প সময়ে বিডিআর দল সেখানে মোতায়েন হতে পারত না। মনে হলো একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত কর্মসূচীর আওতায় এই ধরনের ঘটনার পরপরই বিডিআরের দল নিয়োজিত করার ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের প্রবেশ মুখে এসে দেখলাম বিভাগের দরোজা তালাবদ্ধ। বলা হলো ভেতরে ইতোমধ্যে এত বেশি আহত ব্যক্তি এসেছেন যে কর্তব্যরত ডাক্তাররা আর কারও চিকিৎসা করতে পারবেন না। জরুরী বিভাগের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা/ডাক্তারদের এহেন আচরণ দেখে আমরা হতবিহ্বল হয়ে ইস্কাটনের একটি বেসরকারী ক্লিনিকে কাজী জাফরউল্লাহকে নিয়ে যাই। এই ক্লিনিকের ডাক্তার ও সার্জনরা কাজীর সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। চেনা ডাক্তার ও সার্জনদের কাছে কাজীকে হস্তান্তর করে আমরা সুধা সদনের দিকে ছুটে যাই। সুধা সদনে আমরা রাত ৮.২৫ মিনিটের দিকে পৌঁছি। শয়ে শয়ে বিক্ষোভে ফেটেপড়া জনতা তখন সুধা সদনের সামনে। শেখ হাসিনা নিরাপদে আছেন দেখে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। নেত্রী খানিকটা বিমর্ষ অথচ দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি স্বভাবসুলভ আত্ম-প্রত্যয়ের সাথে সমবেত সবাইকে সাহস ও ক্রাইসিস মোকাবিলা করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে আহতদের নিয়ে যথা-প্রয়োজন চিকিৎসা করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। খানিক পরে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ অন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছুটে এসে শেখ হাসিনাকে তাদের দুঃখ-সহানুভূতি, ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা জানান। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×