ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

বাড়ির ছাদে বাগান

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২২ আগস্ট ২০১৬

বাড়ির ছাদে বাগান

কংক্রিটের চার দেয়ালের মাঝে কার না মন চায় সবুজের ছোঁয়া পেতে? কিন্তু নাগরিক জীবনে যেখানে সুন্দরভাবে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুরই বড় অভাব, সেখানে কোথায় পাবেন এক চিলতে সবুজ? গাছপালা তো দূরের কথা, আলো বাতাসেরও যেন বড় অভাব এখানে। কিন্তু তাই বলে কি আপনার বাসায় একেবারেই সবুজের ছোঁয়া থাকবে না? যাদের বাসার ছাদে খানিকটা খোলামেলা জায়গা আছে তারা ইচ্ছা করলে ছাদেই তৈরি করে নিতে পারেন ছোট্ট এক টুকরো বাগান। পায়ের নিচে নরম ঘাসের স্পর্শ না পেলেও হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারবেন সবুজ পাতা। এটাই বা কম কি এই শহরে? প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর খানিকটা চেষ্টা থাকলে আপনিও গড়ে তুলতে পারেন চমৎকার একটি বাগান। যখন ফুল-ফলে আপনার বাগান ভরে উঠবে, তখন আপনার মনও স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে যাবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হলেও আসুন ছাদে বাগান করি। ইতোমধ্যেই সচেতন নাগরিক সমাজ ছাদে গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছে। চলার পথে এখন মানুষের বাড়ির ছাদে দু’একটি বাগান চোখে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনে গাছের বিকল্প নেই। রাজধানীর স্কুল কলেজের ছাদেও কর্তৃপক্ষ বাগান করতে পারে। এখানে জায়গাটা বেশি পাওয়া যাবে। ছাদে বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে রাজউক উত্তরা কলেজ গাছ লাগিয়ে একটি সুন্দর বাগান করেছে। এভাবে প্রতি স্কুল কলেজ এবং বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো শুরু করে দিতে হবে এখনই। গাছপালা আমাদের জীবনীর উৎস। গাছ শুধু পরিবেশকে বাঁচায় না, বাঁচায় আমাদের জীবন। আমাদের শহরে জীবনের উৎস সেই গাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি এক অনিশ্চিত জীবন। শহরে খালি জায়গা নেই বটে, কিন্তু আছে প্রচুর খালি ছাদ এবং বারান্দা। এই জায়গাগুলোকেও যদি সবুজ করা যেত তাহলে জাতি, দেশ তথা বিশ্ব কিঞ্চিৎ উপকৃত হতো। গাড়ি উঁচু উঁচু ইটকাঠের দালানের শহর ঢাকা এক সময় ছিল বিশাল মহীরুহ ছায়াঘন, বিচিত্র জাতের বৃক্ষের সমাহার ঢাকাকে দিয়েছিল বিরল শোভা আর সৌন্দর্য। কিন্তু এখন সে রূপ আর বৈচিত্র্য উধাও। দশকের পর দশক ধরে বৃক্ষ উজাড়ের মিছিলে ঢাকা তার আগের শ্যামল রূপশোভা হারিয়ে ফেলেছে। আর এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক দুর্লভ গাছ। যেসব দুর্লভ গাছ এখনো কোন মতে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও নগরবাসী ও কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা, অপরিণামদর্শিতা, লোভ আর নগর পরিকল্পকদের ভুলে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অযতেœ আর অবহেলাই এসব দুর্লভ বৃক্ষের ললাটলিখন। রাজধানীতে গাছ শূন্যতা রাজধানীতে সবুজের স্বল্পতা। বাংলাদেশের রূপ মানেই সবুজে ঘেরা এক শ্যামলিমা। ঢাকা শহরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। যখন থেকে এ শহর নগরে রূপ নেয়া শুরু করে তখন থেকে এখানে উদ্যান চিন্তার উন্মেষ ঘটা শুরু। মুঘলরাই এ উপমহাদেশে উদ্যানের ধারণা নিয়ে আসে প্রথম। সম্রাট জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর নিজেই ছিলেন এর অগ্রপথিক। তিনি নিজের আত্মজীবনীতে বলেন, আমি যে সব উদ্যান ও প্রাসাদ নির্মাণ করিয়াছি তাহাতে সমতা রক্ষার কোন ত্রুটি রাখি নাই। প্রত্যেক কোণে সুসামঞ্জস্য উদ্যান তৈরি করিয়াছি এবং তাহাতে নির্ভুল সৌষ্ঠব্যে গোলাপ ও নার্গিস ফুল লাগাইয়াছি। মুঘলরা স্বভাবতই তাদের প্রিয় মধ্য এশীয় গাছপালা এদেশে রোপণ করেছেন। ঢাকা অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও গাছপালা মৃত্তিকাবিদদের মতে, ঢাকা শহর ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তবে ঢাকা শহরে বলধা গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনাসহ বেশকিছু এলাকায় দুর্লভ কিছু গাছের দেখা মেলে। কিন্তু ইট-পাথরের চাপায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার সবুজ রূপ। প্রতিদিন নতুন নতুন বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছে আর কেটে ফেলা হচ্ছে পুরনো বাড়ির চারপাশে দিয়ে থাকা গাছ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষতলের শীতল ছায়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জনপদে জনগণের তিনগুণ গাছ থাকা দরকার। কিন্তু প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে গাছ আছে কয়টি? সঠিক সংখ্যা কারও কাছে না থাকলেও তা দুই-তিন লাখের বেশি হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঢাকা শহরে গাছের কোন পরিসংখ্যান কখনই করা হয়নি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার আয়তন ৩০৪ বর্গকিলোমিটার। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, এই আয়তনের ঠিক কতভাগ গাছ আছে তার কোন হিসেব নেই বন বিভাগ বা খোদ সিটি কর্পোরেশনে। ২০১০ সালে আমগাছকে দেশের জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ঢাকায় আমগাছও চোখে পড়ে না। পার্ক ও রাস্তার দুই পাশের গাছ মরে যাচ্ছে। গত তিন বছরে রাজধানীর প্রায় দুই হাজারের বেশি গাছ মারা গেছে। ঢাকা শহরে এখনও যত গাছ আছে সেগুলোর একটি বড় অংশ উজাড় হওয়ার হুমকির মুখে। এসব বৃক্ষের স্থান দখল করে নিচ্ছে অপরিকল্পিত বাড়ি ঘরের বিস্তার। ফলে বৃক্ষশোভিত ঢাকার অপরূপ নিসর্গ ক্রমশ হয়ে উঠছে ছায়াহীন উষর। নির্মল বায়ুর বদলে ঢাকার আকাশ ঘিরে আছে দূষিত বায়ুর বিষবাষ্পে। এক সময় কেমন অপরূপই না ছিল ঢাকার রূপ। দুই যুগ আগেও আমাদের প্রিয় এই ঢাকা শহর ছিল সবুজে সুশোভিত। পার্কে, সড়কের পাশে ছিল সারিবদ্ধ গাছ। অফিসগুলো ছিল ফুলগাছে শোভিত এবং বাড়িতে ছিল বাগান। আজ ২০১৬ সালে শহরে দেখছি প্রশংসনীয় সব স্থাপত্যশৈলী। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসনের জন্য নির্মিত সুউচ্চ ভবন এবং দৃষ্টিনন্দন বাণিজ্যিক টাওয়ারগুলোর সঙ্গে অতীতের সতেজ সবুজের সহাবস্থান যদি ধরে রাখা যেত তাহলে কি সুন্দর সমাহারই না হতো! এই লক্ষ্য অর্জন কি একেবারেই অসম্ভব? পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণই রয়েছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের মতো অনেক উদাহরণই পৃথিবীর সামনে রয়েছে। এমনকি দুবাইয়ের মতো মরুভূমিকেও বিস্ময়করভাবে আকাশ ছোঁয়া ভবন নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম একটি বড় সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্রেপরিণত করা হয়েছে এবং গোটা শহরটি বাগানে পরিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। এর ফলে মরু শহরটির বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটেছে। আর পুরস্কার বিজয়ী সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তো ইনডোর গার্ডেনের এক অনুপম আধার এবং গোটা শহরটি বিভিন্ন জাতের অর্কিড আর বাগানে পরিপূর্ণ। তাহলে স্থাপত্যশৈলীর অগ্রগতির পাশাপাশি ঢাকার সবুজ শ্যামলিমা কেন টিকিয়ে রাখা যাবে না? নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে ঢাকায় অনুভূত হওয়া শুরু হয়েছে। নগরবাসীকে রেকর্ড ভঙ্গকারী উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে হচ্ছে। গবেষকদের মতে, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রী বেড়েছে। এতে নগরবাসীকে মারাত্মক ধকল পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অসহনীয় তাপপ্রবাহে পুড়তে হচ্ছে। এটা কেবল ঢাকার নাগরিকদের জন্যই দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে না, এমনকি আমাদের ইকোসিস্টেমের অংশ পাখ-পাখালী ও জীবজন্তুকেও তীব্র তাপপ্রবাহের ধকল সহ্য করতে হচ্ছে। এই অসহনীয় তাপমাত্রার পেছনের কারণ কি? এটা বিষুবীয় ঘটনাবলীরই ফলাফল। নিরক্ষরেখার ওপর সূর্যের সরাসরি অবস্থানের কারণে এটা ঘটছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের অনেকেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব সম্পর্কে অবগত। এখন এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মূল কারণ কি হতে পারে? কারণ হচ্ছে, মূল বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। প্রতিদিনই কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাড়ছে এবং বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। আমরা আমাদের জীবন রক্ষাকারী সম্পদ ধ্বংস করে ফেলছি। নগরায়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলছি। ছবি : শেখ মামুন
×