ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খোকন তালুকদার

ফিরতে হবে লোকজ সংস্কৃতিতে

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২২ আগস্ট ২০১৬

ফিরতে হবে লোকজ সংস্কৃতিতে

বর্তমান বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যুগে লোকজ সংস্কৃতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে লোকজ সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করার। কারণ নিজেদের ফিরে পেতে হলে আমাদের বার বার লোকজ সংস্কৃতির কাছেই ফিরে আসতে হয়। সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটছে। আর এই পরিবর্তনের ফলে সংস্কৃতিতে আমরা আজ যে গ্রাম্য সংস্কৃতি দেখতে পাই তার বাস্তব দিকটা ঠিক উল্টো। তার পেছনে রয়েছে লজ্জা আর অন্ধকার। গ্রাম্য শব্দটার মাঝেই কেন জানি লজ্জাকর, অন্ধকার শব্দ দুটো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে আছে। অথচ তার ভেতরে প্রবেশ করলে স্বচ্ছ কাচ ভিন্ন অন্য কিছু পাওয়া যায় না। শুধু মাত্র ভেতরেই নয় গ্রাম্যের বাহিরের দিকটাও স্বচ্ছ কাচেরই ন্যায়। অথচ আমাদের লোক- সংস্কৃতির ভদ্র চর্চা যারা করে তারা মুখে প্রকাশ করলেও অন্তরে তা মেনে নিতে নারাজ। তাই গ্রাম্য সংস্কৃতির একটি বেহাল দিক আলোচনা না করে উপায় নেই। সে কয়েক কাল আগের কথা। তখন গ্রামে খাদ্যের উৎপাদন যেমন কম ছিল, কম ছিল বিলাসিতারও। তারপরেও দুবেলা খেতে না পাওয়া, অশিক্ষিত, বিলাসিতাহীন মানুষগুলোর মাঝে ছিল ঐক্য, ছিল শান্তি। আর এই ঐক্য, শান্তির পেছনের একটি দিক ছিল তখনকার গ্রাম্য গান, গ্রাম্য অভিনয়। অনেকে লেটো গানের দল বলত যাকে। আমাদের কাজী নজরুল ইসলামও সেখান থেকেই উঠে এসেছেন। গ্রামের মধ্যে যাদের একটু প্রভাব ছিল তাদের প্রায় বাড়িতেই একটি করে লেটো গানের দল ছিল। বাড়ির কর্তা নিজেই তাদের খরচ বহন করে পোষতেন। এমনটাও হয়েছে যে, বাড়ির কর্তা স্ত্রী সন্তানদের জন্য কিছুই না এনে এই লেটো গানের সদস্যদের জন্য অনেক কিছুই কিনে নিয়ে আসতেন। এদের চাহিদা মেটানোই যেন ছিল কর্তাদের ধ্যান জ্ঞান। তারপর সপ্তাহব্যাপী গানের উৎসব। কার দল জয় লাভ করে সেটিই ছিল মুখ্য বিষয়। এমনিভাবে গ্রামের অশিক্ষিত, বিলাসিতাহীন মানুষগুলো তাদের আত্মার তৃপ্তি মেটাতেন, এক হয়ে থাকতেন সবাই মিলে। এখানেই ছিল তাদের ঐক্য, এখানেই ছিল তাদের শান্তি। ধীরে ধীরে প্রায় হারিয়েই গেছে আমাদের সেই নিজস্ব সংস্কৃতি। এখন আর হাটে মাঠে বসে না সেসব গানের আসর। তার পরবর্তী সময়ে নতুন করে কেউ আর এসব গানের দলে নাম লেখায়নি। আর তখন এদের মনে যে অবহেলার, অসম্মানের মরিচা ধরে তা আমাদের ভদ্র সমাজ দূর করেনি। এসব ধরে রাখার সময়ও মনে হয় তখন তাদের ছিল না। এই কারণেই এসব লেটো গানের দল এখন আর আমাদের চোখে পরে না। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওইসব অশিক্ষিত, বিলাসিতাহীন মানুষগুলোর সংস্কৃতিটা সভ্যতার অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে অনেকটা অবহেলাজনিত কারণেই। আর এই সংস্কৃতিটাই এখন বাগান থেকে জঙ্গলে রূপ লাভ করেছে। যদিও বর্তমানে লোক-সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করা হচ্ছে। তবে এই চর্চাকে লোক-সংস্কৃতির ভদ্র চর্চা না বলে উপায় নেই। আগেও অনেকে লোক-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, এখনও করছেন। তবে তা গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ। এ চর্চা আটকে আছে টেলিভিশন চ্যানেলে, সভা-সেমিনারে কিংবা মানববন্ধনে। এই সংস্কৃতিকে কেউ আর সৎ সাহসে তুলে আনছেন না বা আনতেও চাচ্ছেন না। সে আমাদের জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক। একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাবিদ তার এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, লোক-সংস্কৃতিকে আমরা টিকিয়ে রাখতে চাই ভদ্রলোকদের প্রয়োজনে, সাধারণ মানুষের প্রয়োজন তাতে মেটে যদি ভাল কিন্তু সে বিবেচনা মুখ্য নয়, গৌণ। নকশি কাঁথার কদর আমরা জানি, তাই বলে তো আর নিত্যনৈতিক শীতবস্ত্রও ত্যাগ করতে পারি না। আজকের মানুষ আর পেছনে ফিরে যেতে পারবে না, মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভবও না। তবে লোক সংস্কৃতিতে যে লজ্জা, অন্ধকার দানা বেঁধে আছে তাকে আলো জ্বালাতে হবে। হাজার বছর ধরে গড়া আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আমাদের মাধ্যমেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না।
×