ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকল রিও, ভাঙল মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২২ আগস্ট ২০১৬

ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য  অংশ হয়ে থাকল রিও, ভাঙল মিলনমেলা

দুই মহাতারকার অবিশ্বাস্য কীর্তিই অমলিন হয়ে থাকল রিও অলিম্পিক গেমসে। টোকিওতে দেখা যাবে না দু’জনের কাউকে। পদকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা যে ’গুডবাই’ জানিয়ে দিলেন অলিম্পিকসকে। যে দুই কিংবদন্তির কথা বলা হচ্ছিল তারা হলেন সাঁতারে সর্বোচ্চ সোনার পদক জিতে অনন্য উচ্চতায় জায়গা করে নেয়া মাইকেল ফেলপস ও ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের মহানয়ক উসাইন বোল্ট। দু’জনের দ্যুতিতেই আলোকিত হয়ে উঠেছিল রিও অলিম্পিক আসর। দুই দিগন্তের অবিসংবাদিত সম্রাট ফেলপস-বোল্টের মানে অন্যরকম এক গ্ল্যালামার। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক দারুণভাবে মিস করবে দুই বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদকে। রিওতে তারা নিজেদের শেষ অলিম্পিক খেলে ফেলায় দুর্ভাগ্য জাপানের। ভিক্টোরি পডিয়ামের সর্বোচ্চ ধাপে থেকে তারাই ছিলেন ২০১৬ ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো আর্থ’-এর অন্যতম আকর্ষণ। হাসি-কান্না, আনন্দ, বেদনার সাক্ষী হয়ে থাকা ১৭ দিনের মহাযজ্ঞ শেষ। উদ্বোধনীর মতো সমাপনীতেও আলোর রোশনাই, নজর কাড়া লেজার শোর রঙিন ফোয়ারার বাহারি উপস্থাপনার মধ্যে বাংলাদেশ সময় রবিবার ভোরে পর্দা নামল গেমসের। ভেঙ্গে গেল সারাবিশ্বের ২০৬ দেশের প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ক্রীড়াবিদের মিলন মেলা। খেলা সাঙ্গ হলেও ফেলপস আর বোল্ট ঝলক সরস আলোচনার খোরাক হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। ইতিহাস রইলেন তারা দুই কারণে, মোট ছয় লড়াইয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেলপস গলায় ঝুলিয়েছেন পাঁচ সোনার মেডেল আর একটি রৌপ্য। আর জ্যামাইকার গতিদানব তো রুপ কথার জন্ম দিলেন, তার বহুল প্রত্যাশিত ‘ট্রিপল-ট্রিপল পূরণ করে। বেজিং, লন্ডনের পর রিও অলিম্পিক, টানা তিন আসরে ট্র্যাকের সবচেয়ে মর্যদার ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ড আরও সুবিন্যস্ত করেন রিলেতেও জ্যামাইকা দলের একই সাফল্যে। গৌরবময় অর্জনে ইতিহাসে অমত্ব পেয়ে গেলেন বোল্ট। আর ফেলপস তো আরেক ইতিহাস। তবে টানা তিন অলিম্পিকে নয় সোনার পদক জয়ের রেকর্ডে বিদ্যুত-বোল্টই যে ছিলেন রিও অলিম্পিকের মহাতারকা। এ নিয়ে আর কোন সংশয় থাকল না। অলিম্পিক শেষ। ৪১ রকমের খেলাগুলোর জন্য নির্মিত ভেন্যুগুলো হয়ে পড়েছে নীরব। যেন ভাঙ্গা হাট। ভিড় সিকিভাগে নেমে এসেছে বিকিনি খ্যাত সুন্দরীদের অপরূপ কোপাকাভানা বিচে। দর্শকরা ফিরে গেছেন নিজ নিজ দেশে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ ব্রাজিলের লোক সংখ্যা সরকারী হিসেবে বিশ কোটি। বিশাল দেশটির ক্রীড়াপ্রেমীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে গেমসের গ্যালারিতে। আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের উন্মত্ততাও যেন কিছুটা বিলীন হয়ে পড়েছে গেমসের মশাল নেভার পর। পাহাড়, সাগর আর সবুজের সমারোহে সুসজ্জিত রিও ডি জেনিরো হচ্ছে ব্রাজিল তথা, বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটক শহর। নয়নাভিরাম রিওতেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আধুনিক অলিম্পিক গেমসের ৩১তম আসর। ব্রাজিলকে বলা হয় ফুটবলের দেশ। সাম্বা ছন্দের ফুটবল খেলেই পৃথিবীতে পরিচিত ব্রাজিল। দেশটির ক্রীড়ার সবচেয়ে বড় অলঙ্কার বলা যায় ফুটবলকে। ফুটবলের দেশে অলিম্পিক, অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন ১৯৫০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ব্রাজিল কি পারবে অয়োজন সফল করতে? আইএস হুমকি, জিকা ভাইরাস আতঙ্ক, সবকিছু উপেক্ষা করে ব্রাজিল কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছে অলিম্পিকের বড় মঞ্চ কিভাবে আলোকিত করা যায়। আশঙ্কার কারণ ব্রাজিল কেন, গোটা দক্ষিণ আমেরিকায় এটিই প্রথম অলিম্পিক শো। অভিজ্ঞতার অভাব বড় করে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু নিজস্ব আধুনিক প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছে পেলে, রোনাল্ডো কাকা, নেইমারদের দেশ ব্রাজিল। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের দেড় বছরের মধ্যে আরেকটি অলিম্পিক নামক বিশাল আয়োজন সফল করে ব্রাজিলের পরিচিতিটাও নিয়ে গেছে অনেক উঁচুতে। বিশ্বব্যাপি পর্যটক শিল্পটাও বিস্তৃত করে নিয়েছে দেশটি। অলিম্পিক গেমস কেন্দ্র করে হাজার হাজার বিদেশীর দীপ্ত পদচারণায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল গোটা রিও। ভয় ভীতির মধ্যেও অলিম্পিক শহরে সম্ভবত এবারই সবচেয়ে বেশি বিদেশীর ভিড়। বিষয়টা ছিল রথ দেখা, কলা বেচার মতো। খেলা উপভোগ আর সমুদ্র সৈকতের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে বিদেশী দর্শক যেন চুম্বকের টানে ছুটে আসেন রিওতে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের রেকর্ড নাকি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি অলিম্পিকের বদৌলতে। প্রমাণ তো পাওয়াই গেল। হোটেল ভাড়া কয়েকগুন বেশি। তারপরও খালি নেই। রুম পাওয়া দায়। চুটিয়ে ব্যবসা করে নিলেন এ্যাপার্টমেন্ট মালিকরা। তিন রুমের ফ্ল্যাটের একটিতে নিজেদের গাদাগাদি। অন্য দুটিতে ভাড়াটিয়া, স্বপ্নের অলিম্পিক দেখতে আসা দর্শক। পকেটের অর্থ যাতে কোনভাবে ফেরত না নিয়ে যেতে পারেন কেউ সে ব্যবস্থায় বড় শিল্প খাতে পরিণত হতে দেখা গেল যৌনকর্মীরা। শহরের অলিম্পিক লাগোয়া এলাকাগুলোর রাস্তা যৌনকর্মীতে ঠাসা। বুঝা দায় হয়ে গেল কে ভাল, আর কে মন্দ। হোটেল, এ্যাপার্টমেন্টগুলোতেও রমরমা একই বাণিজ্য। পকেটে ‘হেইস’ (ব্রাজিলীয় মুদ্রা) নেই তো কী। কুচ পরোয়া নেই। ডলার তো আছে। আর তাও না থকেলে নিশ্চয়ই এটিএম কর্ড অবশ্যই আছে। আধুনিক বিশ্বে এই মুহূর্তে যা অপরিহার্য। নগদ টাকা না থাকলেও এটিএম কার্ড দিয়ে মনের, শরীরের চাহিদা মিটিয়ে নেয়ার ব্যবস্থাও দেখা গেল পতিতা বাণিজ্যে। আসলে বিশ্বের যে কোন দেশে অবশ্য খেলাধুলার বড় আয়োজন মানে বিদেশীদের ভিড়। আর অতিথিদের বিনয়ের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সাদর আমন্ত্রণ কম বেশি সবখানেই দেখা যায়। কিন্তু ব্রাজিলে সেটা অনেক রমরমা মনে হলো। ক্রেডিট কার্ডে পতিতাদের প্যামেন্ট সম্ভবত ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোথাও নেই। পাঠক বুঝতেই পারছেন, ঠেলার প্রস্তুতি কত সমৃদ্ধ। যাগ্যে সে কথা, ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের অপ্রীতিকর কিছু চোখে পরেনি। তবে গেমসের সব রকমের খেলায় অংশ নিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে পরেনি ব্রাজিল। কিন্তু আয়োজক হিসেবে স্বার্থক, সফল তারা। এবার জাপানের পালা। ২০০২ বিশ্বকাপ ফুটবলের যৌথ আয়োজক দেশটির দিকেই চার বছর পর দৃষ্টি থাকবে বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের।
×