ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ায় গৃহবধূ এলাকাছাড়া

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২২ আগস্ট ২০১৬

স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ায় গৃহবধূ এলাকাছাড়া

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা থেকে ॥ স্বামী হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে বাড়িঘর ও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন গৃহবধূ ঝর্ণা আক্তার। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের সিরাজনগর গ্রাম থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অচেনা-অজানা পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদরের তালেবনগর আবাসন প্রকল্পের এক ঘরের বারান্দায় ঠাঁই নিয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের দয়াদাক্ষিণ্যে কোলের দুটি শিশুসন্তান নিয়ে দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। ঝর্ণা আক্তারের অভিযোগ, তার লন্ডন প্রবাসী স্বামী সিরাজউদ্দিনের টাকা হজম করতে সৎ দেবর, ননদ ও শাশুড়িসহ অন্যরা নির্মমভাবে খুন করে লাশ গায়েব করেছে। তাকেও প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এখানে চলে এসেছেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও তিনি কোন প্রতিকার পাননি। ঝর্না আক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী, তার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জের তুষভা-ার গ্রামে। দশ বছর আগে শ্রীমঙ্গলের সিরাজনগর গ্রামের মৃত গিয়াসউদ্দিনের ছেলে সিরাজউদ্দিনের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের অনেক আগ থেকে স্বামী সিরাজউদ্দিন লন্ডন প্রবাসী। বিয়ের পর ভালই চলছিল তার সংসার। স্বামী এক-দেড় বছর পর একবার দেশে আসতেন। এক- দেড় মাস থেকে আবার চলে যেতেন। এ সময়ের মধ্যে তার কোল জুড়ে আসে দুটি সন্তান। এরমধ্যে মেয়ে নদীর বর্তমান বয়স ৬ । আর ছেলে সাগরের বয়স ২ বছর। সর্বশেষ চার মাস আগে স্বামী দেশে আসেন এবং এলাকায় গার্মেন্টস ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী একদিন স্বামী সিরাজউদ্দিন ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা তোলেন। কিন্তু তার স্বামীর ওই নগদ অর্থসহ অন্যান্য বিষয় সম্পদের ওপর নজর পড়ে সৎ শাশুড়ি ও সৎ দেবরসহ অন্যদের। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ঝর্ণা আক্তার জানান, যেদিন তার স্বামী ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন সেদিন গভীর রাতে ৫-৬ জন তার ঘরে ঢুকে প্রথমে তাকে বেঁধে ফেলে এবং তার চোখের সামনে স্বামীকে জবাই করে লাশ গায়েব করে ফেলে। পরেরদিন দিন তিনি শ্রীমঙ্গল থানায় সৎ শাশুড়িসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে অভিযোগ করেন। থানায় অভিযোগ দেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে ঝর্ণা আক্তারকে ওই অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য সৎ দেবর ও ননদরা তাকে নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে তাকে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টা করা হয়। নিজের ও সন্তানদের জীবন বাঁচাতে ঝর্ণা আক্তার ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে সর্বশেষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ১৫ দিন ছিলেন। সেখানেও তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে ঝর্ণা আক্তার বলেন, ঢাকা মেডিক্যালে একদিন ডাক্তার এসে আমাকে বলেন তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তোমাকে ওরা এখানেও মেরে ফেলবে। তুমি সন্তানদের নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। ওই ডাক্তার লোক দিয়ে আমাকে সদরঘাটে এনে লঞ্চে তুলে দেয়। লঞ্চে আমি এখানে চলে আসি। তিনি আরও বলেন, বাবার বাড়িতে যাব সে অবস্থাও নেই। সেখানেও সৎ মা ও সৎভাইরা সংসারে। তারাও আমাকে সম্পত্তির লোভে মেরে ফেলতে চাইছে। ঘটনা প্রসঙ্গে মোবাইল ফোনে শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান বলেন, সিরাজনগরে এ ধরনের কোন ঘটনা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে কোন অভিযোগও আমাদের কাছে নেই। ওই নারী পাগলের প্রলাপ বকছে। তবে ঝর্ণা আক্তার জানান, ঘটনার পর লিখিতভাবে তিনি থানাকে জানিয়েছেন। অভিযোগের কপি আনতে গেলে থানা থেকে তাকে বলা হয়, কপি নেয়ার প্রয়োজন নেই। গত ২০ দিন ধরে ঝর্ণা আক্তার গলাচিপা তালেবনগর আবাসন প্রকল্পের মতি মাস্টারের চায়ের দোকানের পাশের পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। কখনও খাবার জোটে, আবার কখনও উপোসেই কেটে যায় দিন। শিশু দুটির কোন পোশাক নেই। উদোম শরীরে শুধু কাঁদছে। তার নিজেরও এক কাপড়েই দিন কাটছে। স্থানীয় চুন্নু পেয়াদা জানান, লঞ্চ থেকে নেমে ঝর্ণা আক্তার আবাসনের ঘরের বারান্দায় এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা কয়েকজন চাঁদা তুলে চিকিৎসা করিয়েছেন এবং পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় ঠাঁই দিয়েছেন। আবাসন বাসিন্দা মোঃ জসীমউদ্দিন জানান, তারা দু’চার টাকা সাহায্য করেন, এ দিয়ে কোনদিন খাবার হয়। আবার কোনদিন হয় না। তিনি আরও জানান, আবাসনের বাসিন্দারাও দরিদ্র। তাদের পক্ষে কত আর সহায়তা করা সম্ভব ? ঝর্ণা আক্তার জানান, তিনি স্বামী হত্যার বিচার চান। ফিরে যেতে চান স্বামীর ভিটায়।
×