ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এমএ ইউসুফ খান

অভিমত ॥ রেমিটেন্স বাড়াতে দূতাবাসের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২২ আগস্ট ২০১৬

অভিমত ॥ রেমিটেন্স বাড়াতে দূতাবাসের ভূমিকা

সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে উগ্রবাদীদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য চলছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারগুলোও দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বেকারত্বের ফলে জনশক্তি রফতানি বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো ক্রমান্বয়ে শ্রমিক নেয়ার সংখ্যাও কমিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের বিষয়টিই অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। কিন্তু বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে এক অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতি এক ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন থমকে গেছে তেমনি থমকে গেছে নতুন কর্মসংস্থানের হার বা গতি। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশই কাজ করে সৌদি আরবে। তেলের দাম ক্রমাগত পড়তে থাকায় সৌদি আরবের বহু কোম্পানি ইতোমধ্যে উৎপাদন বন্ধ করতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থা নির্মাণ সংস্থাগুলোর। অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে শুরু করেছে। অনেকে মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছে না। ফলে শ্রমিকরা অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বহু বাংলাদেশী শ্রমিক কোন রকমে একবেলা খেয়ে বেঁচে আছেন। এর মধ্যেই একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এ ব্যাপারে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম হলো ‘সৌদি আরবে খাবার সঙ্কটে শতাধিক বাংলাদেশী’। বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মূল কারণ হলো- সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়া শতাধিক বাংলাদেশী বর্তমানে খাবার সঙ্কটে দিনাতিপাত করলেও বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের এই অবস্থার কোন খোঁজখবর নিতে আসেনি বলে ভুক্তভোগী শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন। উল্লেখ্য, সৌদি আরবে বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছে। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসে তার ৪৮ ভাগ রেমিটেন্স আসে সৌদি আরব থেকে। কাজেই জনশক্তি রফতানির এই সর্ববৃহৎ বাজারটি আরও আন্তরিকতা ও যতেœর সঙ্গে পরিচর্যা করা বাঞ্ছনীয়। এ বিশাল শ্রমবাজারটি দীর্ঘ নয় বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সফরে দেখা দিয়েছে নতুন আশার আলো। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে আরও ৫ লাখ জনশক্তি নেয়ার কথা জানানো হয়েছে। এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সুযোগটি কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই সরকারী পর্যায়ে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। আর এর মধ্যেই একটি জাতীয় দৈনিকে সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের দুর্দিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা সম্পর্কে যে নেতিবাচক খবরটি প্রকাশিত হয়েছে তা একদিকে যেমন অমানবিক, অন্যদিকে তেমনি হতাশার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি মালয়েশিয়াতেও বাংলাদেশ দূতাবাসের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে সেখানকার প্রবাসী শ্রমিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মূল মাধ্যম যে এই পরিশ্রমী শ্রমিক গোষ্ঠী তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সই দেশের অর্থনীতিকে সচল ও চাঙ্গা রাখছে। অর্থাৎ প্রবাসী শ্রমিক গোষ্ঠী দেশের সম্পদ। অথচ তারা উপেক্ষিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। তাদের বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো ঠিকমতো দেখভাল করছে না। প্রবাসীরা প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে- এ কথা বলে আমরা তৃপ্তি প্রকাশ করছি। কিন্তু যাদের বদৌলতে এই রেমিটেন্স বাড়ছে তাদের খবর আমরা কতটুকু রাখছি। প্রবাসী শ্রমিকরা কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন, কোথায় কাজ করছেন, তাদের কাজের পরিবেশ কেমন, নিয়োগদাতা কোম্পানি তাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো দিচ্ছে কিনা- এই বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য বিদেশে অন্যান্য দেশের যেমন দূতাবাস রয়েছে তেমনি বাংলাদেশেরও দূতাবাস রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্ব হলো কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবা দেয়া। কিন্তু কার্যত দেখা যায় যে, তারা বেশিরভাগ সময় ভিআইপি অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি খেয়াল করার সময় ও সুযোগ থাকে না বললেই চলে। এ জন্য প্রায়শই শোনা যায় বা পত্রিকার খবরে দেখা যায় যে, প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসগুলো তাদের প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি সহযোগিতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে কাজ করে থাকেন। কিন্তু আমরা তা করছি না। আর এসব কারণেই বাংলাদেশ রেমিটেন্স আহরণের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ প্রবাসী রেমিটেন্স আয় এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কাজেই যে কোন সমস্যা সমাধানে যত বেশি দেরি হবে পরিস্থিতি ততই জটিল আকার ধারণ করবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৫ দেশে বাংলাদেশের ৭২টি মিশন রয়েছে। যার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস ৫৪, স্থায়ী মিশন ২, কনস্যুলেট জেনারেল ৮, ডেপুটি হাইকমিশন ৩, সহকারী হাইকমিশন ২, কনস্যুলেট ১ ও একটি ভিসা অফিস। এ ছাড়া আরও ৬৯টি দেশের সঙ্গে বিদেশস্থ আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। বাকি দেশগুলোর সঙ্গে অবৈতনিক কনসাল জেনারেল নিয়োগের মাধ্যমে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখা হয়। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি মানুষ প্রবাসী। তাদের দেখভাল করার জন্য বিভিন্ন দেশে দূতাবাস বা বাংলাদেশ মিশন রয়েছে। কিন্তু দূতাবাস বা মিশনগুলো কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ সকল দূতাবাসের ভূমিকা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। তার পরেও অভিযোগ-অনুযোগ কমছে না। এই দূতাবাসগুলো যদি আন্তরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের স্বার্থ দেখভাল করার পাশাপাশি সম্ভাব্য শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করত তাহলে রেমিটেন্সের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যেত। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে যেত। যা হোক, বর্তমানে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাস দুটি অবিলম্বে বিপদগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়াবেÑ এটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, পিপল্স লিজিং এ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লি.
×