ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক ময়নাতদন্তে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও আরও কিছু পরীক্ষা বাকি থাকার কথা জানালেন ডাক্তার

আফসানার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট এখনও খোলেনি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২২ আগস্ট ২০১৬

আফসানার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট এখনও খোলেনি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর মিরপুর সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্রী ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ফেরদৌসী আফসানা আত্মহত্যা করেছেন। রবিবার তার মরদেহের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক একেএম শফিউজ্জামান এ তথ্য জানান। এদিকে আফসানা আত্মহত্যা করেছেনÑ এমন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। অপরদিকে আফসানার ফরেনসিক রিপোর্ট প্রত্যাখ্যানও করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এছাড়া ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে আজ সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে পদযাত্রা করবে সংগঠনটি। আফসানার লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক একেএম শফিউজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে আফসানা আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। তার শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে আরও কিছু পরীক্ষা বাকি থাকায় আফসানাকে ধর্ষণ কিংবা বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সহকারী অধ্যাপক শফিউজ্জামান জানান, আত্মহত্যার যে ধরনের লক্ষণ থাকে, আফসানার ক্ষেত্রে সেগুলো পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার আলামত পাওয়া গেছে। তবে সে ধর্ষিত হয়েছিল কিনা, তা জানার জন্য ভিসেরা এবং হাইভেজনাল সফটের টিস্যু সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। নিহতের পরিবারের ক্ষোভ ॥ আফসানা ফেরদৌস আত্মহত্যা করেছেনÑ এমন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করেন, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে প্রভাবশালী মহলের চাপে এমন প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। ন্যায়বিচারের আশায় তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। নিহত আফসানার ভাই ফজলে রাব্বী বলেন, আমরা হতভম্ব। এলাকাবাসী যখন বলছে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পেয়েছেÑ তখন কিভাবে ময়নাতদন্তকারী এটাকে আত্মহত্যা বলতে পারলেন? আমি বিশ্বাস করি না আমার বোন আত্মহত্যা করেছে। ঘটনার পর তার বন্ধু হাবিবুর রহমান রবিন যে আচরণ করেছে, সমঝোতার চেষ্টা করেছে, সেটার পর আত্মহত্যা ভাবার কোন কারণ দেখি না। ময়নাতদন্ত রিপোর্টকে বানোয়াট উল্লেখ করে তিনি জানান, এ ঘটনা তনু হত্যাকাণ্ডের মতোই ঘটতে চলেছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। আমরা এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি। ফজলে রাব্বি অভিযোগ করেন, আফসানাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্তে আত্মহত্যার কথা বলে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি জানান, শুরু থেকেই বলছিলাম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেখার পর আমরা হত্যা মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেব। আশা করছি আজকের মধ্যে মামলা দায়ের করা সম্ভব হবে। নিহত আফসানার মা স্কুলশিক্ষিকা সৈয়দা ইয়াসমিন জানান, দেশে কোন আইনকানুন নেই। সবকিছু টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। আফসানা কখনই আত্মহত্যা করেনি। তিনি জানান, রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে রবিন ও তার কয়েক বন্ধু মিলে আফসানাকে হত্যা করেছে। এখন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে। আফসানার মামা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, হাসপাতালে যারা আফসানার মরদেহ চিকিৎসার নামে ফেলে রেখে গেছে তারাই প্রকৃত খুনী। সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারা সরকারদলীয় প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ তাদের এখনও আটক করছে না। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আফসানার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের তেজগাঁও কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন লাপাত্তা। গত শনিবার থেকেই কলেজে আসছেন না বলে দাবি করেছেন অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর কলেজে সক্রিয় নেতা রবিনকে এখন আর নিজেদের কেউ বলে স্বীকারও করছে না ছাত্রলীগ। নিহতের পরিবারিক সূত্র জানায়, কিছুদিন ধরে আফসানার সঙ্গে রবিনের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। আফসানার মা বলেন, তাদের মধ্যে কোন একটা বিষয়ে ঝামেলা চলছিল, যা বন্ধুরা মিলে ঠিক করে দেয় কিছুদিন আগে। তারপরও কিছু ঝামেলা চলছিল বলে আমরা শুনেছিলাম। সূত্রগুলো জানায়, আফসানা নিহত হওয়ার পর তার মানিকদীর বাসার প্রতিবেশীরা জানায় আফসানা ও রবিন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসাভাড়া নিয়েছিল। যদিও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। জানা গেছে, আফসানার বাবা আখতার হোসেন ছয় মাস আগে মারা গেছেন। মা সৈয়দা ইয়াসমিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ২০১০ সালে আফসানা ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর ঢাকার শেরেবাংলা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে সেই কলেজ ছেড়ে ২০১৩ সালে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় সাইক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট নামের একটি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা সেনানিবাসের মানিকদী এলাকার একটি বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। আফসানার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রুহিয়া কানিকশালগাঁওয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আফসানা দ্বিতীয়। ছাত্র ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে পদযাত্রা ॥ আফসানার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এছাড়া ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে আজ সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে পদযাত্রা করবে সংগঠনটি। রবিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচী ঘোষণা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি লাকী আক্তার। সংবাদ সম্মেলনে লাকী বলেন, আফসানার অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রমাণ করে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ফরেনসিক রিপোর্টের নামে প্রহসন করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে। একই সঙ্গে সব জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কথাও জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তুহিন কান্তি দাস ও হাসিব মুহাম্মদ আশিক। উল্লেখ্য, গত ১১ আগস্ট আফসানা নিখোঁজ হন। গত ১৩ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে কাফরুল থানাধীন মিরপুরের সেনপাড়ার আল-হেলাল হাসপাতালে কয়েক যুবক আফসানার লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। পরে কাফরুল থানা পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। ওই দিন কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফজলুল হক জানান, বিকেল ৪টার দিকে অজ্ঞাতপরিচয় কিছু ব্যক্তি ওই নারীকে (আফসানা) মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত আল-হেলাল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে এলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তখন ওই ব্যক্তিরা সিএনজির ভাড়া দেয়ার কথা বলে পালিয়ে যায়। মৃতের গলায় দাগ রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে আফসানার মৃত্যুকে হত্যা দাবি করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঢাকা, ঠাকুরগাঁও ও রাজবাড়ীতে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। আফসানাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তার কথিত বন্ধু তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিনকে শুরু থেকে দায়ী করে আসছে তার পরিবার। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরও সন্দেহভাজন ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রবিনকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিকদার মোঃ শামীম হোসেন জানান, আফসানার বিষয়টি নিয়ে একটি মামলা হয়েছে। তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
×