ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ-উল-আযহার প্রস্তুতি

কোরবানির হাটে জালনোট প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২২ আগস্ট ২০১৬

কোরবানির হাটে জালনোট প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা

রহিম শেখ ॥ আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আযহা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে কোরবানি পশুর হাটগুলোতে কেনাবেচা জমে উঠবে। এর পরের মাসেই অনুষ্ঠিত হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। বড় এ দুই উৎসবকে সামনে রেখে তৎপরতা বাড়ছে জাল টাকার কারবারিদের। কোরবানির পশুর হাটে জাল নোটের বিস্তার প্রতিরোধে এবার মাঠে থাকবে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া প্রতিটি হাটে একাধিক বুথ বসিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার নোট যাচাই করে দেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আর জাল নোট প্রতিরোধের এ কর্মসূচী সমন্বয় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে ব্যাংকিং কর্মদিবস চলাকালীন তাদের শাখার টিভি মনিটরে আসল নোটের নিরাপত্তা সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী মাসের ১২ সেপ্টেম্বর ঈদ-উল আযহা অনুষ্ঠিত হতে পারে। এর সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই কোরবানি পশু কেনার হাট জমে উঠবে। এছাড়া উপহার সামগ্রীসহ অন্য পোশাক-আশাক কেনার ধুম পড়বে। পরের মাসেই অনুষ্ঠিত হবে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এ দুই উৎসবে নগদ টাকার লেনদেন বাড়ে কয়েকগুণ। বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেনের এ সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। জানা গেছে, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি চক্র। এদের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত নোটগুলোর মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটই বেশি পরিমাণে জাল হচ্ছে। জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম ও নোটসহ যেসব প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই ওই সব নোটের জালকারী। ৫০ ও ১০০ টাকা মূল্যমানের নোটগুলো এখন জাল হচ্ছে না বললেই চলে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাল নোটসহ গ্রেফতার করা চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ থাকলেও এক্ষেত্রে জোরালো কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয়, ওই সব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল টাকা প্রতিরোধ কমিটির সভায় বারবার বিষয়টি তুলে ধরা হলেও নেয়া হচ্ছে না কার্র্যকর কোন উদ্যোগ। অনুসন্ধানে জানা যায়, এক হাজার টাকার মতো বড় নোটই জাল হয় বেশি। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে ছাপানো এসব জাল টাকা মানুষের হাত ঘুরে চলে আসে নগদ লেনদেনের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জালটাকা শনাক্তকারী মেশিন ধরতে পারে না। তিনি আরও বলেন, এজন্য প্রতিটি টাকার নোট চোখে দেখে শনাক্ত করে রাখতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও কার্যক্রম জোরদারের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে পাঠানো চিঠিতে পশুর হাটের তালিকা এবং হাটগুলোতে ব্যাংকের বুথ স্থাপনে সহযোগিতা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এবারও সারাদেশের পশুর হাটে জাল নোট যাচাই সেবা দেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এজন্য সম্প্রতি পৃথক চিঠিতে ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে পশুর হাটের তালিকা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ও ঢাকা জেলার হাটগুলোর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ চালু রাখবে। রাজধানীর অনুমোদিত হাটের তালিকা পাওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বুথের কার্যক্রম মনিটর করবে। এছাড়া জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটি ও জেলা কমিটিগুলোকেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে গত বুধবার দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে ব্যাংকিং কর্মদিবস চলাকালীন তাদের শাখার টিভি মনিটরে আসল নোটের নিরাপত্তা সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে দেশের সব টিভি চ্যানেলে প্রাইম টাইমে আসল নোট চেনার উপায় সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রচারের অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, পশু কেনাবেচা বা অন্য যে কোন লেনদেনে সাধারণ মানুষ যাতে প্রতারণার শিকার না হন সেজন্য এবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পশুর হাটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জাল নোট যাচাই বুথ স্থাপন ও ব্যাংকগুলোর শাখার টিভি মনিটরেও আসল নোটের ভিডিও প্রচার এবং সব টিভি চ্যানেলকে প্রাইম টাইমে আসল নোটের ওপর ভিডিওচিত্র প্রচারের অনুরোধ করা হবে। জল নোটের অপতৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাঠে থাকতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জাল নোট যাচাই মেশিন সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র আরও জানায়, শুধু টিভি মনিটরে ভিডিওচিত্র প্রচারই নয়, ব্যাংকিং লেনদেন ও এটিএম বুথে টাকা ঢোকানোর আগে ব্যাংকগুলোকে জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিনের ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। গেল কোরবারির ঈদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী রাজধানীসহ সারাদেশের পশুর হাটে ৪৬০টি জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও মেশিনের চাহিদাপত্র চেয়ে সম্প্রতি র‌্যাব মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এখনও তাদের থেকে ওই চিঠির জবাব আসেনি। আসল নোট চেনার সহজ উপায় ॥ সম্প্রতি জাল টাকা প্রতিরোধে আসল নোটের বৈশিষ্ট্য সংবলিত বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান চারটি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে। ১. প্রত্যেক প্রকার নোটেই মূল্যবান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা রয়েছে। নোটের মূল্যমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার ৪টি স্থানে মুদ্রিত আছে। নোট চিত করে ধরলে নিরাপত্তা সুতায় মূল্যমান এবং লোগো দেখা যাবে। কিন্তু কাত করে খাড়াভাবে ধরলে তা কালো দেখা যাবে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত বা নোটের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে উক্ত নিরাপত্তা সূতা কোনক্রমেই উঠানো সম্ভব নয়। জালনোট নিরাপত্তা সূতা সহজেই নখের আঁচড়ে বা মুচড়ানোতে উঠে যায়। ২. প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডানদিকে কোনায় ইংরেজী সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত রয়েছে। ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট আস্তে আস্তে নড়াচড়া করলে নোটের মূল্যমান লেখাটি সোনালি হতে ক্রমেই সবুজ রঙে পরিবর্তিত হয়। একইভাবে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোটে ৫০০ মূল্যমান লেখাটি লালচে হতে পরিবর্তিত হয়ে সবুজ হয়। জাল নোটে ব্যবহৃত এ রং চকচক করলেও তা পরিবর্তিত হয় না। ৩. প্রত্যেক প্রকার নোটের সম্মুখ ও পশ্চাত পৃষ্ঠের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং ৭টি সমান্তরাল সরলরেখা উঁচু-নিচুভাবে (খসখসে) মুদ্রিত আছে। তাছাড়া নোটের ডানদিকে ১০০ টাকার নোটে ৩টি, ৫০০ টাকার নোটে ৪টি এবং ১০০০ টাকার নোটে ৫টি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে, যা হাতের স্পর্শে উঁচু-নিচু (খসখসে) অনুভূত হয়। ৪. প্রত্যেক প্রকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞাপনটিতে আরও বলা হয়, এ সকল বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
×