ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জজ মিয়া নাটকের তিন কুশীলব বেশ আরামেই আছেন

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ আগস্ট ২০১৬

জজ মিয়া নাটকের তিন কুশীলব বেশ আরামেই আছেন

শংকর কুমার দে/গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের রাষ্ট্রীয় নাটকের ট্রাজিক হিরো জজ মিয়া। চরম মিথ্যাচার দিয়ে সাজানো নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে সিআইডি। সিআইডির তিন কর্মকর্তার শিখিয়ে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ানোর জন্য তার ভাগ্যে জোটে মাসোহারা, অকথ্য নির্যাতন, ক্রসফায়ারের ভীতি প্রদর্শন, চার বছর কারাবাস। অথচ সেই তিন সিআইডি কর্মকর্তা দিব্যি জামিনে রয়েছেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রাষ্ট্রীয় নির্লজ্জ মিথ্যাচারের এক সাক্ষী জজ মিয়া। এখনও কোন তদন্ত বা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়ার আভাস পাওয়া গেলেই মানুষজনের মুখে মুখে ফিরে, ‘জজ মিয়া নাটক যেন না হয়’। মুক্তজীবনে থাকা জজ মিয়া ও তার পরিবার আজও অজানা আতঙ্কে ভোগে। সেই দিনমজুর অভাবী জজ মিয়ার এখন কেউ আর খবরও রাখে না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন রাজধানীর মতিঝিল থানায় ২২ আগস্ট হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক ২টি মামলা হয়। প্রথম দফায় মতিঝিল থানার এসআই আমীর হোসেন আর দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শামসুল ইসলাম মামলার তদন্ত করেন। মামলা তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান তড়িঘড়ি করে মামলা সিআইডি পুলিশের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। মামলা চলে যায় সিআইডিতে। বাবরের নির্দেশে শুরু হয় মামলা তদন্তের নামে প্রহসন। প্রথম দফায় মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানকে। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তিনি ঢাকার ৫৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেছুর রহমান, শৈবাল সাহা পার্থ, আব্বাসসহ ২০ জনকে পরিকল্পিতভাবে গ্রেফতার করে। এছাড়া ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে দরিদ্র পরিবারের সন্তান জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তাকে সোজা মালিবাগ সিআইডি অফিসে নেয়া হয়। সামান্য দিনমজুর। জজ মিয়ার পুরো পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়ার লোভ দেখায় সিআইডি। প্রথম দিকে সিআইডির প্রস্তাবে রাজি হয়নি জজ মিয়া। এরপর জজ মিয়ার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। সিআইডির কথামতো না চললে জজ মিয়াকে কমপক্ষে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। ফলে সারাজীবন জেলের অন্ধকারে থাকতে হবে। এ জীবনে আলোর মুখ দেখা হবে না। এমন ভয় দেখানো হয় জজ মিয়াকে। সর্বশেষ এতেও রাজি না হলে জজ মিয়াকে চোখ বেঁধে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যায় জজ মিয়া। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে জজ মিয়ার সিআইডির কথামতো রাজি হয়। এমন চাপের মুখে জজ মিয়া আদালতে গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়। জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পরদিন ২০০৫ সালের ১০ জুন গুলশান থানায় তদন্তাধীন থাকা এক ব্যবসায়ী হত্যার পুরনো মামলায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার হয় দুই ভায়রা আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলাম। তাদেরও গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ দু’জনকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করেন সিআইডির আলোচিত তিন কর্মকর্তা। এমন জবানবন্দীকে পুঁজি করেই ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর ১৫ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ১১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিলের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চার্জশীটের অনুলিপি দেয় সিআইডির এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান। মুন্সী আতিকের তদন্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রশ্ন তুললে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুর রশীদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আব্দুর রশিদ ও ঢাকা মেট্রোর ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সুপারভাইজার (এসএস) এসপি রুহুল আমিন মামলা তদন্তের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। মামলার তদন্ত নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটির পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীরকে। তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে জজ মিয়া নাটকসহ চাঞ্চল্যকর কাহিনী। সিআইডি সূত্র বলছে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সমাবেশে বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতেই পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল। ২১ আগস্টের পর সারাদেশ থেকে ৭৫টি ৮৪ মডেলের আর্জেস গ্রেনেড গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে, যা পাকিস্তানের তৈরি অধিক উচ্চমাত্রা বিস্ফোরক বলে পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি গ্রেনেড ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর এক খুনীর সেলের সামনে থেকে কারা কর্তৃপক্ষ ও লালবাগ থানা পুলিশ উদ্ধার করে। শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলায় মারা গেলে গ্রেনেডের বিস্ফোরক ঘটিয়ে কারাগারের মূল ফটক উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নান ও আবু জান্দালসহ ১৪ জন বর্তমানে কারাগারে বন্দী রয়েছে। বাকি আসামিদের মধ্যে উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন পাকিস্তানে পলাতক রয়েছে বলে পুলিশের ইন্টারপুল সূত্র জানায়। এদিকে জজ মিয়া নাটক সাজানোসহ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহ এবং মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর পল্টন থানায় আলোচিত তিন সিআইডি কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়। গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশীট দাখিলকারী কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীর বাদী ওই মামলাটি দায়ের করেন। দায়েরকৃত ওই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহ, জোরপূর্বক জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামকে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করাসহ মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগ আনা হয়। এ মামলাটি সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী তদন্ত করেন। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলাম, জজ মিয়ার মা জোবেদা বেগম, বোন খুরশীদা বেগম, ভাই আবুল হোসেন, রাজধানীর ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মোখলেছুর রহমান, শৈবাল সাহা পার্থ, আরিফ, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণকারী দুই বিচারক শফিক আনোয়ার ও জাহাঙ্গীর আলম এবং সিআইডির তিন কর্মকর্তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। সিআইডিকে দেয়া জবানবন্দীতে জজ মিয়া নাটক সাজানোর কাহিনীর বর্ণনা করেন। এছাড়াও নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার বহুল আলোচিত জজ মিয়ার ৬ প্রতিবেশীও সিআইডি পুলিশের কাছে জবানবন্দী দেন। তারা জানান, ২১ আগস্ট জজ মিয়া বাড়িতেই ছিল। প্রতিদিনের মতো জজ মিয়া বাড়ির কাজ সেরে বিকেলে বাড়ির কাছের বাজারে যায়। বিকেলে তাদের সঙ্গে বসে জজ মিয়া বাজারের একটি দোকানে টেলিভিশন দেখছিল। পরে সংবাদ মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, জজ মিয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি। ঢাকার সিআইডি পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেফতার করেছে। জজ মিয়ার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর তার মাকে প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য দুই হাজার টাকা করে নিয়মিত প্রদান করছিল সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে তাও বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই জেলহাজত থেকে ছাড়া পায় জজ মিয়া। বিনা অপরাধে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান চারটি বছর। জজ মিয়া গ্রেফতারের পর তার সংসারে নেমে আসে চরম অর্থকষ্ট। অর্ধাহার-অনাহারে জীবন কাটে তার বৃদ্ধা মা, এক বোন ও ভাইয়ের। জোবেদা খাতুন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে বাঁচার তাগিদে ঢাকায় চলে আসেন। জজ মিয়ার দাবি, ২১ আগস্ট এলেই তার খোঁজখবর নেয় সবাই। এরপর আর কেউ খবর রাখে না। তিনি সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের জন্য একটি বাসস্থান ও একটি চাকরির দাবি করেন সরকারের কাছে। তিন সিআইডি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত করেন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী। তদন্তে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সিআইডির সাবেক ওই তিন কর্মকর্তা ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজিয়েছিলেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার চার্জশীট দিয়েছে সিআইডি। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশীট দাখিলকারী কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আলোচিত ওই তিন কর্মকর্তা বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
×