ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

২১ আগস্ট ॥ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও আজকের জঙ্গী তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২১ আগস্ট ২০১৬

২১ আগস্ট ॥ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও আজকের জঙ্গী তৎপরতা

সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে যখন রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, এজেন্সি ও সরকার বা সরকারের কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা থাকে তখন সেটিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার সবচাইতে ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভার ওপর জঙ্গী আক্রমণ হয় এবং তাতে ২৪ নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। তখন জামায়াত-বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এবং জামায়াতের দুজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। এ সংক্রান্ত মামলা বিচারিক আদালতে এখন নিষ্পত্তির জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে শুনেছি। অভিযুক্ত হিসেবে আছেন বিএনপির অন্যতম কর্ণধার তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ওই সময়ের আরও কয়েক বিএনপি-জামায়াতের নেতা-মন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তা। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা আদালতই বলবেন। উল্লিখিত অভিযুক্তগণ যদি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে আলোচ্য ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনাটি সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত হবে। আদালত সব সময়ই মহামান্য। তবে দেশের মানুষ, রাষ্ট্রচিন্তক ও বিশ্লেষকদের মতামতের গুরুত্বকে কখনও খাটো করে দেখা যাবে না। তাই ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, ঘটনা-উত্তর সময়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কার্যক্রম, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য-উপাত্তের দিকে নজর দিলে এই ঘটনাকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে মনে হবে। এক. আওয়ামী লীগ দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল, যে দলের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশাল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী, যে বিচারে আওয়ামী লীগের সমকক্ষ কোন দল বাংলাদেশে নেই। দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যিনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী এবং ঘটনার সময় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। এই দল ও নেত্রীর পূর্বঘোষিত জনসভায় পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তখনকার সরকারের। কিন্তু সেদিন আমরা কী দেখলাম। জনসভা স্থলে কয়েক শ’ পোশাকধারী পুলিশ নিয়োজিত ছিল, বিপুল সংখ্যক গোয়েন্দা ও সাদা পোশাকের পুলিশও থাকার কথা। এর আগে কয়েকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই কথা উঠেছে, বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের নজর এড়িয়ে জঙ্গীরা এতগুলো গ্রেনেড নিয়ে কি করে একেবারে মঞ্চের ৩০-৪০ গজের মধ্যে গিয়ে অবস্থান নিল? আক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ সমানে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে আক্রান্ত মানুষের ওপর, তাতে ওখানে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ আরও দিশেহারা হয়ে পড়ে। টিয়ার গ্যাসে সৃষ্ট ধোঁয়ার আড়ালে আক্রমণকারীরা সকলের চোখ এড়িয়ে সহজে স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হয়। দুই. পরের দিন সকালে গ্রেনেডের আঘাতে বিধ্বস্ত ট্রাক, পড়ে থাকা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, লোকজনের ফেলে যাওয়া জুতা-স্যান্ডেলসহ অন্য সকল কিছু ঘটনার স্থান থেকে সরিয়ে নেয়া হলো এবং স্থানটি পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়; অর্থাৎ সমস্ত আলামত নষ্ট করে দেয়া হলো। তিন. ঘটনাস্থলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কারখানায় তৈরি একটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। একই গ্রেনেড পাওয়া যায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে, যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিরা অবস্থান করছিল। চার. অনেক তল্লাশির পর নোয়াখালীর এক দিনমজুর জজ মিয়াকে গ্রেনেড আক্রমণের মূল হোতা হিসেবে গ্রেফতার ও জনসমক্ষে উপস্থিত করলেন আমাদের করিৎকর্মা পুলিশ। এটি জজ মিয়া নাটক নামে বহুল আলোচিত ও পরিচিত। পাঁচ. ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এই গ্রেনেড আক্রমণের অন্যতম পরিকল্পনাকারী হুজি নেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রকাশ হওয়ার পর সব পরিষ্কার হয়ে যায়। জজ মিয়া নাটকের অবসান ঘটে। ছয়. দেশের অন্যতম প্রধান ইংরেজী দৈনিক আলোচ্য ঘটনার ওপর ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপায়। তাতে দেখা যায় হাওয়া ভবনে বসে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়। হরকত-উল-জিহাদ মূল পরিকল্পনাকারীদের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করে। পরিকল্পনাকারীরা হাওয়া ভবন এবং প্রতিমন্ত্রী আবদুস ছালাম পিন্টুর বাসায় একাধিক সমন্বয় সভা করে। বর্ণিত এক থেকে ছয় ক্রমিক নম্বরের তথ্য-উপাত্ত আদালতে সঠিক প্রমাণিত হলে এটা ইতিহাসের সবচাইতে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-, জেলের ভেতর চার জাতীয় নেতা হত্যা, একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতের পুনরুত্থান এবং পঁচাত্তরের পরে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় দর্শনের বিলোপ সাধন এবং তার পরিবর্তে পাকিস্তানে অনুসৃত সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রবর্তন ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ করলে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপট ও সঠিক কারণ বোঝা যাবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াইটা করে আমরা জয়ী হয়েছিলাম সেই লড়াইটা আবার শুরু হলো পঁচাত্তরের পর। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালী সংস্কৃতিভিত্তিক দর্শন, ভার্সেস সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দর্শন। রাজনৈতিকভাবে প্রথম পক্ষের নেতৃত্বে আছেন আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় পক্ষে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সঙ্গীরা। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সেদিন শেষ হয়ে গেলে কি হতো! নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী সংস্কৃতিভিত্তিক দর্শনের আবার মৃত্যু ঘটত। নামে বাংলাদেশ, কার্যত আমরা এতদিনে একটি চরম সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে যেতাম এবং আইএস-আল কায়েদা ও পাকিস্তানী তালেবানদের আরেকটি ব্যাটলগ্রাউন্ডে পরিণত হতো বাংলাদেশ। সেটা হতে পারেনি। মাটি ও প্রকৃতির প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অসাম্প্রদায়িক ও উদার চেতনায় সমৃদ্ধ। তাছাড়া একবিংশ শতাব্দীর গ্লোবাল কনসেপ্ট এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তার সমীকরণ এ সময়ে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুকূলে থেকেছে এবং আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক জোট ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে বিপরীত পক্ষ রাজনৈতিকভাবে না পেরে তাদের পুরনো সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে নতুন কৌশলে মাঠে নামিয়েছে। পুরনো লড়াইয়ের নতুন রূপ। সহাবস্থান অসম্ভবরূপী দুই বিপরীতমুখী দর্শনের লড়াই, যার শুরু পাকিস্তান আমলে এবং পুনরায় শুরু পঁচাত্তরের পর। যার প্রতিফলন ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণসহ বিগত দিনে দেখেছি এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে এসে আমরা দেখছি জঙ্গীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ, ধর্মগুরু-যাজক ও বিদেশী নাগরিকদের আক্রমণ এবং হত্যা করছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ ১ জুলাই গুলশানের রেস্তরাঁয় আহাররত বিদেশী নাগরিকদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ। এই কৌশল ও উপরোক্ত শ্রেণীর টার্গেট নির্ধারণের লক্ষ্য হলো, যাতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে বিজেপি সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং জীবনভয়ে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশ ত্যাগ করে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থমকে যায়। ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের উল্লিখিত প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে এবং সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে জঙ্গী ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের বাংলাদেশে টিকে থাকার পথ সুগম হয়। গুলশানে জঙ্গী আক্রমণে এক সঙ্গে ১৭ বিদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়া ও সৃষ্ট পরিবেশ আমার উপরোক্ত কথার যথার্থতা প্রমাণ করে। তবে এখন বলতে পারি জঙ্গীদের আশা পূরণ হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে এবং ভারতও জঙ্গী দমনে সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ধৃত ও শাস্তি হওয়া জঙ্গী এবং ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিবাদের খাগড়াগড়ে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশী জেএমবি সদস্যদের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, তাদের প্রস্তুতি ও জঙ্গী তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং তার সরকারকে উৎখাত করা। সুতরাং একাত্তরে পরাজিত সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক দর্শনের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পঁচাত্তরের পর নতুনরূপে তার উত্থানে অবিরাম টার্গেটে রয়েছেন শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট সেটারই বহির্প্রকাশ এবং তাদেরই আরেক রূপ আজকের জঙ্গীবাদ ও দেশী-বিদেশী নিরীহ মানুষ হত্যা। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×