ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ একজনই বাঙালী

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২১ আগস্ট ২০১৬

একুশ শতক ॥ একজনই বাঙালী

চার দশকেরও বেশি সময় আগে বাংলার মাটিকে রক্ত দিয়ে পবিত্র করে যাকে সপরিবারে শহীদ হতে হয়েছিল তার সম্পর্কে দুটি বাক্য লিখতে আর কার কি হয় জানি না, আমার তো হাত কাঁপে। কোনভাবেই আমি তাঁকে নিয়ে লেখার সাহস পাই না। এত বড় মাপের মানুষ তাঁকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার মতো নগণ্য একজনের থাকতেই পারে না। আমি তাঁর ভক্ত-সৈনিক। আমার চারপাশে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় কোন রাজনীতিককে আমি দেখি না। আমার পাঠ করা ইতিহাসের পাতাতেও নেই। বাংলাদেশ তো দূরের কথা সারা দুনিয়াতেই তিনি একজন। তিনি কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী নন। তাঁকে আমি মনে করি একজনই বাঙালী, যার মাঝে বাঙালিত্বের পুরোটা আছে এবং সেজন্য তিনি সকল বাঙালীর, সকল বাংলাভাষীর অনুসরণীয়। অথচ চারপাশে তাকে নিয়ে কোটি কোটি হরফ দেখি। যিনি যেভাবে চান তাকে সেভাবেই তিনি উপস্থাপন করছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে তাঁর নীতি, আদর্শ বা কর্মপন্থাকে আমরা এখনও সেভাবে মূল্যায়ন করি না যেভাবে সেটি করা দরকার। অনেক ভাবনা থেকে তাঁর সম্পর্কে একটি দুই পাতার নিবন্ধ লেখার সাহসও এতদিন পাইনি। এবার যখন ৬৮ বছরে পা দিলাম তখন মনে হলো এই মহামানব সম্পর্কে নিজের ভাবনাটা প্রকাশ করে যাওয়াটা নিজের কাছে জবাবদিহি করার মতো একটি বিষয়। নইলে এক সময়ে মনে হবে আমি তাঁকে যেমনটি ভাবি সেটি তো কাউকে বলিনি। মনে মনে ভাবছি যদি সময় পাই তবে আমি তাঁকে একটু বিস্তারিতভাবেই মূল্যায়ন করব। তাঁর নাম শুনেছি ’৬৬ সালে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করি। সেখানেই ছয় দফা নামক একটি লিফলেট বিলাতে গিয়ে প্রথম জেনেছি যে বাঙালীরা তাদের প্রাপ্য পায় না। তার আগে স্কুল জীবনে পাকসার জমিন সাদ বাদ গেয়ে পাকিস্তানী হওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৬৫ সাল ছিল প্রথম যখন ঢাকা শহরে এসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কুশপুতুল জ্বালাতে দেখেছি। ৬ দফা পাঠ করে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, আমি বাঙালী এবং আমার একটি আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা ভূখ- রয়েছে। ’৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুনলাম, বাঙালীদের একজনই নেতা তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ১১ দফায় সেই ছয় দফা যুক্ত হয় আর রাজপথে তাঁর মুক্তির দাবিতে মিছিল করার মধ্যদিয়ে নিজের সেøøাগান দেয়ার ক্ষমতাকে শাণিত করি। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগণ্য একজন কর্মী হিসেবে তাঁর সামনে যাওয়ার কোন কারণই ছিল না। তবে যারা তাঁর কাছে থাকতেন তাদের সঙ্গে আমরা দিন-রাত কাটাতাম বলে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা-জীবনাচার বা রাজনৈতিক দর্শন জানতে পারতাম। সেই মানুষটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন নিয়ে ইতিহাস লেখার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। অনেকে লিখেছেন, লিখবেন এবং সারাবিশ্ব তাঁকে নিয়ে গবেষণা করবে, বর্তমানের প্রেক্ষিতে এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে তার কন্যা বাংলার স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যেখানে স্থাপন করেছেন তাতে সারা বিশ্বকে জানতেই হবে, কে এই দেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাহীন ঝুড়ির দেশ এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সামনে আদর্শ দেশ, এই রূপান্তরটা তো আমাদের জানতেই হবে। আমাদের এই দেশটির জনক প্রথম আমাকে আকৃষ্ট করেন তাঁর অতি সাধারণ জীবনযাপন, সহজ সরল অভিব্যক্তি এবং স্পষ্টবাদিতায়। ঢাকা কলেজ থেকেই তাঁর বড় ছেলে শেখ কামালকে চিনতাম। শেখ কামালের মাঝে তাঁর পারিবারিক ধারার প্রতিপালন ছিল। ’৭০ সালে সারা বাংলাদেশে তিনি যখন অবিসংবাদিত নেতা তখন তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তখন বিবাহিতা। তাঁকে দেখে আমি আরও অভিভূত হই। যার অঙ্গুলি হেলনে পাকিস্তান কেঁপে ওঠে সেই মানুষটির বড় মেয়ে তাঁতের শাড়ি পরে সহপাঠীদের সঙ্গে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই মিশে, এটি শেখ হাসিনাকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। শেখ কামালও তাই ছিল। আমাদের সঙ্গে নাটক করত। তাকে দেখেও কেউ ভাবতে পারত না যে তার পিতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য জনগণের রায় পেয়ে আছেন। আমি স্মরণ করতে পারি তখন তিনি কেবল তার রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এমনকি তাদের পারিবারিক তথ্যও মনে রাখতেন। সেই মানুষটির সাধারণ মূল্যায়ন যখন আমরা করি তখন কেবল তাঁর বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিই। যে সময়ে ব্রিটিশরা পুরা উপমহাদেশটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলঙ্কিত করে দুটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এবং পুরো উপমহাদেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন, তখন তিনি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেন। ভাবা যায় যে পাকিস্তান তৈরির ৫ মাসের মাঝে জিন্নার মুখের ওপর কেউ না না চিৎকার করে নিজের মাতৃভাষার দাবিকে উত্থাপন করতে পারেন। এই অঞ্চলে ভাষারাষ্ট্র ধারণা তখন মোটেই গুরুত্ব পায়নি। ভারত বহুভাষিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। খুব সঙ্গত কারণেই ভারতের ধর্মরাষ্ট্র হওয়ারও খুব সুযোগ ছিল না। তবুও ব্রিটিশরা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছিল। ভারতের নেতারাও সেটি প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান হয়ে ওঠে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু সেই মানুষটি যিনি বাংলাদেশের অন্তরকে অনুভব করেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাঙালী যে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সবার ওপরে ঠাঁই দেয় এবং তার এই জীবন ধারায় ধর্ম যে প্রধান শক্তি নয় সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আমি নিজে অভিভূত হই যখন দেখি যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে থেকে তাঁর রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উপড়ে ফেলে দিতে পারেন। যে মানুষটি নিজেকে স্পষ্ট করে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারেন যে তিনি বাঙালী, মানুষ এবং তারপরে মুসলমান, কেবল সেই মানুষটিই পাকিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের চোখের সামনে পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেন! আজ তাঁর মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পর আমাদের আইনমন্ত্রীকে বলতে হয় যে, আমরা অবশ্যই ’৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাব। তিনি নিজেই অনুভব করেন যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমরা ফেরত যেতে পারিনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা দেশটিকে যেভাবে পাকিস্তানের দূরবর্তী অঙ্গরাজ্য বানিয়েছিল, সেটির সংবিধান আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো করে ফিরে যেতে পারিনি। আমরা কেবল বিসমিল্লাহ রাখিনি, তাতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও রেখেছি। ভাবুন দেখি, তিনি কেবল মুসলিম শব্দ বর্জন করেননি, মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে টুকরো করে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আমার জানা মতে তাঁর হাতে তৈরি ’৭২ সালের সংবিধানটি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংবিধান, যার সঙ্গে তুলনা করার মতো কোন সংবিধান অন্তত এই অঞ্চলে পাওয়া যায় না। এই সংবিধানকে ছিন্ন ভিন্ন করে জিয়া ও এরশাদ কেবল যে সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করে তাই নয়, এর গণতান্ত্রিক চরিত্রও বিনষ্ট করে। আমাদের জন্য দুঃখজনক যে ’৭৫ থেকে ’৯৬ সাল অবধি দেশে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গড়ে তোলা হয় যে বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেও এখন ’৭২-এর সংবিধানের মূল চরিত্রে ফেরত যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন যদি তিনি সেই কাজটি করেন তবে রাজনীতির ছকটাকে উল্টানোর অপচেষ্টা করা হবে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী ও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনীতি প্রবলভাবে জোরদার করা হবে। সংবিধানকে নিয়েই মুসলিম আবেগ জোরদার করা হবে এবং এর জন্য যত রকমের ষড়যন্ত্র করা যায় সেটি করতেই থাকবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর বিরাজ করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ দুর্বল হওয়ার পর পুঁজিবাদের একতরফা বিকাশ, চীনের আপোসকামিতা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হুবহু যেতে পারছি না। আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে বুঝবেন না যেভাবে আমরা তাঁকে চিনি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, তাঁর প্রতি একনিষ্ঠতা এবং জাতিসত্তা বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখ লাখ তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা এখন মনে করেন যে, পাকিস্তান আমাদের ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি এবং বনিবনা হয়নি বলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে, তারা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে বুঝতেই পারেন না। কোন সন্দেহ নেই যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনভাবে গড়ে তোলেন যে সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এটি প্রমাণ করেছি যে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ’৪৮ সালেই তিনি এটি বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালীদের নয় এবং বাঙালীদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন, অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন। তিনি একদিকে নির্বাচন করেছেন, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠে বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেই সেøাগানও তুলে দিয়েছেন। বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তাঁর তৈরি করা ’৭২-এর সংবিধান বুঝতে হবে। তাঁর ’৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিল চারটি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ধীরে ধীরে আমরা সেই চার নীতির গণতন্ত্র ছাড়া বাকি সবই এড়িয়ে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করে না। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। হয়ত কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র ও তার ধারণা কাজে লাগানো ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়ে কায়িক শ্রমনির্ভর মালিক শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধাশ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণীচরিত্র বা শ্রেণী সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাবে। কোন এক মার্ক্সকে নতুন করে সমাজতন্ত্রের কথা বর্ণনা করতে হবে- ব্যাখ্যা করতে হবে। তবে সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশকে আবার লড়াই করতে হচ্ছে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধর্ম পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। একই কারণে বাঙালীর জাতিসত্তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণরা ইসলামী জঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই, পুরো বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানীরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়। আমরা পাকিস্তানীদের পরাজিত করে এর জবাব দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাঁকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধুর মতো আর কোন রাষ্ট্রনায়ক বাঙালীর মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেননি। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যে মুজিব অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বলেছিলেন, ভুল হোক শুদ্ধ হোক আমরা সরকারী কাজে বাংলাই লিখব। কালক্রমে সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সরে গেছে। বাংলাদেশের বেসরকারী অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে ডিজিটাল করার নামে বাংলা হরফকে বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা নেই। যে মানুষটি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন, সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি। একটি সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল বলছে, ফেসবুকে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ বাঙালী বাংলা ব্যবহার করে। কী ভয়ঙ্কর একটি চিত্র এতে প্রকাশিত হয়। আমি চাই না আমার অনুমান সত্য হোক, কিন্তু মনে হচ্ছে এক সময়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা গ্রামের মানুষ ছাড়া বাংলা হরফই আমরা দেখব না। আপনি চারপাশে খোঁজ নিলেই দেখবেন, তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে না। এই হীনম্মন্য জাতির ভবিষ্যত কি? যে ভাষারাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখান থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন্ জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি সেটি আমি মোটেই বুঝি না। আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষারাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সকল ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালীকেই অনুসরণ করি যাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা, ১৯ আগস্ট, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected], www.bijoydigital.com
×