ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ভুয়া জন্মদিনে কেক কাটা পরিত্যাগ এবং তারপর...?

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২০ আগস্ট ২০১৬

ভুয়া জন্মদিনে কেক কাটা পরিত্যাগ এবং তারপর...?

এবারের জাতীয় শোক দিবসে অনেক বেশি মানুষ রাজপথে নেমেছে, শোক মিছিল করেছে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের কমতি ছিল না। বিশেষ করে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে ভোর ৬টা থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল, যা বিকেল পর্যন্ত গড়িয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হাজারো ব্যানার নিয়ে ফুলের তোড়া হাতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে স্থাপিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। কিছু রাষ্ট্রবিরোধী ঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বঙ্গবন্ধু ভবনেই তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। সেই ভয়াবহ কালরাতে কেবল বঙ্গবন্ধু নন, বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব এবং এমনকি ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল ঘাতকরা। মানুষ সেই রাতে শাহাদাতবরণকারী সকলের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের পক্ষে আমি, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, কার্তিক চ্যাটার্জি, আশরাফ আলীসহ আমরা কয়েকজন ফুলের তোড়া হাতে এক রকম ঠেলেঠুলে বেদি পর্যন্ত পৌঁছলে মাইকে আমাদের নাম বার বার ঘোষণা করা হয়। এখানেই একটি কালো পাথরে লেখা রয়েছে “যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান” (অন্নদা শংকর রায়) লাইন দুটি লেখা ছিল। প্রতিকৃতিতে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন আওয়ামী লীগের শাহে আলম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা কাওসার, পঙ্কজ কুমার দেবনাথ। তারা বার বার আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। সম্ভবত এ কারণে যে, জাতীয় প্রেসক্লাবও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। বস্তুত গত বছরের প্রথমার্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাংবাদিকগণ (সদস্য) রীতিমতো আন্দোলন করে জামায়াত-শিবির-বিএনপির কবল থেকে ক্লাব মুক্ত করে। এভাবে ২০১৫-এর জাতীয় শোক দিবসে ক্লাবে জাতির পিতার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। সেই থেকে ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনেও শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আমাদের প্রেসক্লাব এবং সাংবাদিক ইউনিয়ন এক সঙ্গে গত ৯ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতেও শ্রদ্ধা নিবেদন ও শহীদানের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করে। এতে গোলাম সারওয়ার, ইকবাল সোহবান চৌধুরীসহ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। ১৫ আগস্ট পূর্বাহ্নে প্রেসক্লাবে স্থাপিত প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর ক্লাবে আর্তমানবতার সেবায় রক্তদান কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। এই কর্মসূচীতে সহযোগিতা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডাঃ কামরুল হাসান খান, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডাঃ শরফুদ্দিন ও অন্যরা। রক্তদান করেন ক্লাব সদস্য ও কর্মচারীগণ। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার ও ছাত্ররা ‘সন্ধানী’ নামে যে ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করে ’৮০-এর দশকে তার শুরুটাও হয়েছিল প্রেসক্লাব ও সন্ধানীর যৌথ আয়োজনে। তখন আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম এবং সন্ধানীর প্রধান ছিল সম্ভবত ডাঃ আজাদ। তবে এবারের জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অতীতের মতো ঢাউসমার্কা কেক কেটে তার ভুয়া জন্মদিন পালন করেননি। কেন হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত নিলেন বোঝা মুশকিল। তবে কাগজে দেখেছি ‘বন্যার্ত মানুষের দুর্দশার’ কথা চিন্তা করে নাকি কেক কাটেননি। কিন্তু এটি কৈফিয়ত না অন্য কোন চক্রান্তের অংশ তা এখনই বলা যাবে না। তিনি কেক না কাটলেও দল তার জন্মদিন পালন করেছে এই ১৫ আগস্টে। জন্মদিন মানে ভুয়া বানোয়াট জন্মদিন। কেননা ’৯০-এর দশকে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তৎকালীন দৈনিক বাংলা পত্রিকার একদল আধা বাংলাদেশী আধা পাকিস্তানী সাংবাদিক তার জন্মদিন আবিষ্কার করে ১৫ আগস্ট অর্থাৎ জাতির পিতার শাহাদাত দিবসে। বাজারে যেসব তথ্য রয়েছে তাতে করে আগে এই তারিখ ছিল না। বরং স্কুলে তার এক তারিখ (যদিও স্কুলের গ-ি পার হতে পারেননি), বিয়ের কাবিনে আরেক তারিখ, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরেক তারিখ চলছিল। ’৯০-এর দশকে হঠাৎ ১৫ আগস্ট কেক কেটে জন্মদিন পালন করার পেছনে রয়েছে বিকৃত মানসিকতা, বিকৃত আনন্দ। সম্প্রতি তার দলের পুনর্গঠনের চিত্রের দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, তিনি কতটা বিকৃতি পছন্দ করেন। পুনর্গঠিত কমিটিতে তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও কার্যকর হওয়া চট্টগ্রামের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বা সাকা চৌধুরীর পুত্র, জয়পুর হাটের আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত ও মৃত রাজাকার আলীমের পুত্র; ২০০৪-এর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার আসামি, কিংবা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি লুৎফুজ্জামান বাবরকেও নতুন কমিটিতে নেয়া হয়েছে। ইঙ্গিতটি খুব সোজা। তিনি তার নেগেটিভ লাইন অব পলিটিক্স থেকে এতটুকু সরে আসেননি। এই চালাকি তার প্রয়াত স্বামী মিলিটারি জিয়ার মতো। সিভিল সোসাইটি নামক কতিপয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী প্রায়ই বলে বেড়ান ‘জিয়া’ তো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য হলো জিয়া তার মিলিটারি কুুদেতার চরিত্র এতটুকু পাল্টাননি। সরাসরি বিরুদ্ধে কথা না বললেও বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রচলিত ধারণা। বহু তথ্য-প্রমাণও রয়েছে সমাজে। যার ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে জিয়া একে একে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধান কেটে-ছেঁটে দেন। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলা যাবে না, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বলতে হবে, বাংলাদেশ বেতার বলা যাবে না, তেমনি একদিকে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ করা মদ-জুয়া-হাউজি- যাত্রার নামে উদ্দাম নৃত্য পুনরায় চালু করেন; একই সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগ তথা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মকা- পুনরায় চালু করে দেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকালে সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং সব পাকিস্তানী দালালের স্রষ্টা গোলাম আযমকে পাকিস্তানী পাসপোর্টে দেশে ফিরিয়ে আনেন আর খালেদার আমলে সে খোয়ানো নাগরিকত্ব ফিরে পায়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের দাবিদার জিয়া (যুদ্ধের মাঝামাঝি থেকে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না) সেদিন এসব অপকর্ম না করলে আজ জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসারুল ইসলাম, হামযা ব্রিগেড (ওরা একেকবার একেক নাম ধারণ করে) প্রভৃতি হিংস্র্র ঘাতক বাহিনী সৃষ্টি হতো না। অর্থাৎ আজ যে জঙ্গীবাদের সঙ্কট রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে, জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষটি দেশব্যাপী যেভাবে ডালপালা ছড়িয়ে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে আচ্ছন্ন করতে চাইছে, তার চারাগাছটি রোপণ করেন মিলিটারি জিয়াই। সেদিন তিনি ওই অপকর্মটি না করলে আজ রাষ্ট্রকে একটি অনভিপ্রেত সঙ্কট মোকাবেলা করতে হতো না। খালেদা জিয়াও তার স্বামীর পথ থেকে সরেছেন এমন দাবি যে করবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে। বরং আমার মনে হয় তার সাম্প্রতিক দল পুনর্গঠনের উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার রশি ধরার জন্য আবারও ১৩, ১৪, ১৫, ১৬-এর মতো নাশকতার পথে অগ্রসর হওয়া। অবশ্য এ পথে যাওয়া ছাড়া তার উপায়ইবা কি? এক নম্বর তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ১৯৮৩ সালে দলের চেয়ারপার্সন, এতদিনেও ভদ্র মহিলা দেশপ্রেমের একটি পরীক্ষায়ও উত্তীর্র্ণ হতে পারেননি। পারবেন কি করে? তিনি তো স্কুলের পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা বা দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন কি করে? দ্বিতীয়ত, আজ একদিকে বার্ধক্য আরেকদিকে দুই সন্তানের একজন প্রয়াত, অপরজন দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিদেশে পলাতক, এভাবে তার উত্তরাধিকার সঙ্কট রয়েছে। জীবিত ছেলেরও লেখাপড়া তারই মতো। তৃতীয়ত, জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে দ্রুতগতিতে উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এগিয়ে চলেছে তাকে মোকাবেলা তো বিশ্বই করতে পারছে না, খালেদার মতো এক সাধারণ নারী করবেন কি করে? উন্নয়নের গতির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। চতুর্থত, তার (খালেদার) বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক দুর্নীতির মামলা, রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত তো শঙ্কা কাটছে না। পঞ্চমত, সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো দলের নতুন কমিটিতে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিপন্থীদের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে তাতে করে বিএনপি নামক দলটির সর্বনাশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ খালেদা জিয়া বিএনপি কফিনে লাস্ট জামায়াতী পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন। এখন পেছনে মোড় নেয়া ছাড়া উপায়ইবা কি? হতাশার রাজনীতি অথবা রাজনীতির হতাশা তাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, এখন আর কেক কাটার রাজনীতি কাজ করছে না, তাই অন্য কোন বিকৃত চিন্তা তার মধ্যে কাজ করছে। মনে হয় তাও অচিরেই পরিষ্কার হবে এবং সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ঢাকা : ১৯ আগস্ট ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×