ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু

দলিত সম্প্রদায়কে সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২০ আগস্ট ২০১৬

দলিত সম্প্রদায়কে সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

সমুদ্র হক ॥ দেশে এই প্রথম দলিত শ্রেণী এবং অবহেলিত পেশার মানুষদের সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে একত্রিত করার পর আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা দিয়ে জীবনমান উন্নয়নের পথ দেখানো হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলায় এই প্রশিক্ষণ চলছে। এসব দলিতদের তালিকায় আছে মুচি, ক্ষৌরকার (নাপিত) বেদে হরিজন, হিজড়াসহ সকল দলিত সম্প্রদায়। এতদিন তারা কোন সহযোগিতা পায়নি। সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বছর তিনেক আগে অবহেলিত থার্ড জেন্ডার হিজড়াদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রথমে পাইলট প্রকল্পের আওতায় তাদের প্রশক্ষিণ দেয়া হয়। তাদের একত্রিত করে ঘরে প্রশিক্ষণ দেয়া সহজ ছিল না। বিচ্ছিন্ন এই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তাদের অসংলগ্ন ও অপ্রীতিকর শারীরিক ভাষার পরিবর্তন আনতে সমাজসেবার প্রশিক্ষকদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এক পর্যায়ে তারা আয়ত্তে আসে। পাইলট প্রকল্পের এই সফলতার পর সারাদেশে এই কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছর ওই জনগোষ্ঠীরা থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং অবহেলিত সকল সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলায় দলিত সম্প্রদায় মুচি (রবিদাস হিসেবেও পরিচিত), হরিজন, নাপিত, বেদে হিজড়াসহ অন্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বগুড়া সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় উল্লিখিত সম্প্রদায়ের একশ’জনকে নানামুখী প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণের সময়কাল টানা ৫০ দিন। চলমান প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে বছরে এক বা একাধিকবার এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে সারাদেশে। প্রশিক্ষণের সময়ে যে যে পেশায় আছে বা কাজ করছে তার ওপর প্রশিক্ষণ এবং যারা কিছু করছে না তাদেরও নানা পেশায় টানা হচ্ছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষায় উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। তারা যে অবহেলিত নয় তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষক সাংবাদিকরা। বগুড়ার বারোপুর সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্রের সম্মেলন কক্ষে অংশ নেয়া রবিদাস সম্প্রদায়ের (মুচি) বিজয় বললেন, কোনদিন ভাবতেও পারেননি তাদের এমন প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। টানা ৫০ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে তাদের রোজগার যেন বন্ধ না থাকে, এজন্য প্রতিদিন প্রত্যেককে ৪৬০ টাকা করে দেয়া হয়। এভাবে তারা প্রত্যেককে ৫০ দিনে পাবে ২৩ হাজার টাকা করে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা যে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছে সেই উপকরণ কেনা বাবদ এককালীন পাবে ১০ হাজার টাকা। এই অর্থের অতিরিক্ত লাগলে তারও যোগান দেয়া হবে। এই প্রশিক্ষণে হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রতিদিন প্রত্যেকে পাবে ৪৮০ টাকা করে। ৫০ দিনে প্রত্যেকে পাবে ২৪ হাজার টাকা করে। এরপরও তারা প্রশিক্ষণলব্ধ কোন কাজ করতে চাইলে উপকরণ কেনা বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। সমাজকল্যাণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানালেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সাধারণত হোটেলগুলোতে রান্নার কাজ করে। তারা ভাল রাঁধুনী বা রন্ধন কারিগর। বগুড়ার বড় হোটেলগুলোর বেশিরভাগ রন্ধন কারিগর হিজড়া। তারা হোটেল ছাড়াও শহরের কোন অনুষ্ঠানের খাবারের আয়োজনে রান্না করে দিয়ে আসে। এ জন্য পারিশ্রমিক নেয়। এই বিষয়ে এক প্রশিক্ষক বললেন, হিজড়া রন্ধন কারিগরদের লেখাপড়া ও উন্নত প্রশিক্ষণ দিলে তারকাখচিত হোটেলে সেফ, সহকারী সেফ নিয়োগের পরীক্ষা দিতে পারে। বিষয়টি সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিকল্পনা বিভাগ বিবেচনায় আনতে পারে। এদিকে এই প্রশিক্ষণে বেদে সম্প্রদায়ও উপকৃত হচ্ছে। একটা সময় বেদেরা সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি সর্প দংশনে রোগীকে কথিত ভাল করার শিকড় বাকড় বেচত। বেদে মেয়েরা বাঁশের ঝাঁকি মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে টোটকা চিকিৎসা করত। বেদেদের মধ্যে জেলে এবং চুড়ি ফিতা ব্যবসায়ী আছে। সকল ধরনের বেদের সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এই বেদেরা প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেদের জীবনমান উন্নত করার সহযোগিতা পাচ্ছে। যে বেদেরা সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হচ্ছে। জেলে বেদেদের মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাছ ধরার উপকরণ ও নৌকা বানানোর অর্থ সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। হরিজন সম্প্রদায় ছিল সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। এদের আরেকটি সহজ পরিচয় সুইপার। বর্তমানে স্যানিটেশনের সফলতায় সুইপারদের কার্যক্রম কমে গেছে তারা এখন রাস্তা ঝাড়ুসহ সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ঝাড়ুদার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। এই জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নানা কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) খোরশেদ আলম বললেন, দলিত সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজে তুলে আনা সরকারের একটি বড় পদক্ষেপ। তিনিও তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বগুড়া সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম বললেন সমাজের অবহেলিত এসব ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিলে যে কতটা উপকৃত হয় তার প্রমাণ মিলছে।
×