ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন ধারার নব্য জেএমবি এখন আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ আগস্ট ২০১৬

নতুন ধারার নব্য জেএমবি এখন আতঙ্ক

শংকর কুমার দে ॥ নতুন ধারার নব্য জেএমবি এখন আতংক। জামায়াত-শিবির, মাদ্রাসার ছাত্র ও বিত্তবান পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ছাত্র বা তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত এই জেএমবি একটি রসায়ন (কেমিস্ট্রি)। উচ্চ শিক্ষিত সন্তানদের নিয়ে বিত্তবান অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। এই জঙ্গী সংগঠনটি দমন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। গুলশান, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা ও কল্যাণপুরের আস্তানায় অভিযানের পর নতুন ধারার এই নব্য জেএমবি চোখ খুলে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এই নব্য জেএমবির জঙ্গীরা হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন বিশেষ করে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নাম ব্যবহার করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার মামলায় গ্রেফতারকৃত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানকেও নব্য জেএমবির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর নিহত পাঁচ জঙ্গীর অন্তত তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত ও বিত্তবান ঘরের সন্তান। আর দুই জন মাদ্রাসার ছাত্র। এটা জঙ্গী সংগঠনের জন্য একটা নতুন রসায়ন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিন জঙ্গী হামলার সময়ে নিহত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ধরা পড়ার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত আরেক জঙ্গী মাদ্রাসার ছাত্র। অনুরূপভাবে কল্যাণপুর আস্তানায় অভিযানকালে নিহত নয় জঙ্গীর মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্রেরও পরিচয় পাওয়া যায়। এরই মধ্যে ধরা পড়েছে চার নারী জঙ্গী যাদের মধ্যে তিন জনই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও অপরজন ইন্টার্ন ডাক্তার। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত দুই বছর ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, পুলিশ, বিদেশী নাগরিক, ধর্মযাজক, পুরোহিতসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা ও হামলা চালানো হয়েছে তখন জঙ্গীদের সম্পর্কে ধারণা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। শুধুমাত্র মাদ্রাসার ছাত্ররা বা উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধরাই এই ধরনের একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ধরে নিয়েই তদন্ত ও অনুসন্ধান চালানোর মধ্যে যারা ধরা পড়েছে তারা কেউই বিত্তবান ঘরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র বা তরুণদের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি। হলি আর্টিজানে হামলার পর জানাজানি হয় এরা বিত্তবান ঘরের সন্তান। গোয়েন্দা সূত্র মতে, এরপর ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলন, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ ও রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জে গির্জা এবং নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা, বইমেলার বাইরে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ইউনুসের উপর হামলা হলেও তার পেছনে যে সংঘবদ্ধ জঙ্গীরা রয়েছে তা তখন পর্যন্ত ছিল অজানা। আর তখন হামলার দায় স্বীকার করে কোন সংগঠনের কোন ধরনের বার্তাও আসেনি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানোর সময় প্রতিটি স্থানে প্রচারপত্র রেখে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় জেএমবি। গত শতকের ৯০ দশকে গঠিত এই দলটি প্রকাশ্যে আসার আগে রাজশাহীর বাগমারায় এক ধরনের মহড়াও দিচ্ছিল বলে গোয়েন্দারা বলছেন। ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর ঝালকাঠীতে বিচারক ও গাজীপুর আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন এলাকায় আদালত লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে জেএমবি। বাংলাদেশে আত্মঘাতী হামলা এই জেএমবির মধ্য দিয়েই শুরু হয়। ঝালকাঠীর দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসি কার্যকর হয় আমির শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ জেএমবির ছয় শীর্ষনেতার। এরপর প্রকাশ্য তৎপরতা কমে আসে এই সংগঠনটির। আগে শুধু আদালত লক্ষ্য করে হামলা হলেও ২০১৩ সালের পর হামলার ধরন বদলে শুরু হয় গুপ্তহত্যা। নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে একের পর এক হামলা হতে থাকে; সেটা কখনও নির্জন রাস্তায়, কখনও ব্যস্ত সড়কে, কখনও বাড়িতে, কখনও কার্যালয়ে। হামলাস্থলে পড়ে ছিল রাবি শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর লাশ, এই হত্যাকা- জেএমবি ঘটিয়েছে বলে পুলিশের দাবি। অসাম্প্রদায়িক লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা এবং সবশেষে বিদেশীরা। শুরুতে গ্রেনেড ও বোমা হামলা চালিয়ে হামলার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা থেকে ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের পর এখন দেখা যাচ্ছে একে-২২ রাইফেল, পিস্তলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র। তখন জঙ্গী হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের নাম এলেও এখন বিদেশ থেকে পড়ে আসা এবং দেশের নামী সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরও দেখা যাচ্ছে এই ‘নব্য জেএমবিতে’। আধুনিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা সচ্ছল পরিবারের এই তরুণ-যুবকদের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতায় গোয়েন্দারাও হিমশিম খাচ্ছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পুলিশের চোখে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মেরে তিন জেএমবি নেতাকে জঙ্গীরা ছিনিয়ে নেয়ার পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তারপর গত ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশ জানায়, কানাডা প্রবাসী তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় আছে এখন ‘নব্য জেএমবি’। বাংলাদেশে আইএস তার শাখার প্রধান হিসেবে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল বলে তাদের কথিত সাময়িকী দাবিকে খবর প্রকাশিত হয়েছিল; তামিম চৌধুরীই সেই ব্যক্তি বলে এখন মনে করছেন গোয়েন্দারা।
×