ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুর রাহমানের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গর্ব

স্বাধীনতার অমর কবিতা উপহার দেয়া পাড়াতলী গ্রাম, পায়নি কিছুই

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২০ আগস্ট ২০১৬

স্বাধীনতার অমর কবিতা উপহার দেয়া পাড়াতলী গ্রাম, পায়নি কিছুই

মোরসালিন মিজান ॥ শামসুর রাহমান নাগরিক কবি। পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম। জীবনের অধিকাংশ সময় রাজধানী শহরে কাটিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার যে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন কবি, সেখানে নগর-ই নগর। অথচ কী আশ্চর্য ঘটনা! একটি গ্রামের নাম না নিলে তার সৃষ্টির আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। থেকে যেতে বাধ্য। নয়নাভিরাম গ্রামটির নাম পাড়াতলী। নরসিংদী জেলার রায়পুরায় অবস্থিত। এখানে অল্পদিন ছিলেন তিনি। পিতৃপুরুষের ভিটা বলে কথা, কবিকে অগ্রাহ্য করেনি। বরং দু’হাত ভরে দিয়েছিল। গ্রামের সবুজ বৃক্ষের নিচে বসে কবির লেখা দুটি কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। কালজয়ী রচনার একটি ‘স্বাধীনতা তুমি’। অন্যটি ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। ‘যমজ’ কবিতার গ্রামটির কথা অনেকেই জানেন। সেটা কবিতা পড়েই। আর সম্প্রতি সৌভাগ্য হয় গ্রামটি ঘুরে দেখার। প্রিয় কবির কালজয়ী কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গ্রাম! আহ, দেখার সত্যি কোন তুলনা হয় না। কবির দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পাড়াতলী যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে শামসুর রাহমান ফাউন্ডেশন। যাত্রা শুরু হয় বুধবার সকালে। কয়েক ঘণ্টা চলার পর মাইক্রোবাস যেখানে নামিয়ে দেয়, সেখানে শামসুর রাহমানের অতি প্রিয় মেঘনা নদীর শুরু। নৌকা বাঁধা ছিল ঘাটে। ঘাটের সুন্দর একটি নামÑ পান্থশালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলতে শুরু করে ইঞ্জিনের নৌকা। অমনি মনে পড়ে যায় কবির সেই লেখাটিÑ মেঘনা নদী দেব পাড়ি কল-অলা এক নায়ে।/ আবার আমি যাব আমার পাড়াতলী গাঁয়ে...। চারপাশে থৈ থৈ জল। ঢেউ ভেঙ্গে নৌকা ছুটে চলেছে। কবির পুত্রবধূ টিয়া রাহমান আঙ্গুল তুলে সামনের দিকে দেখালেন। বললেন, ওই যে সবুজ দেখছেন, ওটাই পাড়াতলী। তার পর কেমন যেন শোকগ্রস্ত হয়ে যান। বলেন, শেষবার আব্বুর (শামসুর রাহমান) সঙ্গে এসেছিলাম। সেটা ২০১১ সালের শেষ দিকে। এতকাল পর আবার যাচ্ছি। যেতে যেতে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই স্মৃতি। টিয়া বলেন, আব্বুর পায়ে ব্যথা ছিল। হাঁটতে পারছিলেন না। তাঁর জন্য ইঞ্জিনের নৌকায় রিক্সা উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। গ্রামে তখন শর্ষেক্ষেত। দেখে কী যে একটা আনন্দ তার চোখে-মুখে! ছোট বাচ্চাদের মতো করছিলেন। নাসির আলী মামুন সঙ্গে ছিলেন। শর্ষেক্ষেতে শুয়ে-বসে ছবি তোলা হলো। কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন অতীতে চলে যান কবির পুত্রবধূ। কবির নাতনি দীপিতা ও নয়নাকে বর্তমানেই থাকতে হয়। প্রথমবারের মতো যাচ্ছিলেন পূর্বপুরুষের ভিটায়। কেমন যেন কৌতূহল। নৌকার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন পুরোটা সময়। দু’জনই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন মেঘনার সফেদ জলরাশি। এভাবে আধা ঘণ্টার কিছু বেশি সময়। ছোট্ট একটা খালের মতো জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে নৌকা। পানিতে সাঁতার কাটা হাঁসের দল একটু সরে গিয়ে যেন জায়গা করে দেয়। নোঙর ফেলা হয় যেখানে, শর্ষের ক্ষেত। এখন শূন্য। নরম মাটিতে পা ফেলতেই কবি পরিবারের কয়েকজন স্বাগত জানালেন। বললেন, এটাই পাড়াতলী। মেঘনার চরে জেগে ওঠা গ্রাম। আলপথ ধরে উপরের দিকে উঠতেই একাধিক প্রাচীন বৃক্ষ। কোন একটির মগডাল থেকে ঘুঘু ডাকছিল। একে অভ্যর্থনা সঙ্গীত ভাবতেই বেশি ভাল লাগছিল। সরু রাস্তার দুই পাশে ঘন বাঁশঝাড়। কাঁচা বাড়িঘর। পাশেই গরুটি বাঁধা। দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা। কয়েক মিনিট চলার পর যেখানে সবাই দাঁড়ান সেটি পুকুরঘাট। কবি লিখেছিলেনÑ গাছ-ঘেরা ঐ পুকুরপাড়ে বসব বিকাল বেলা। দু-চোখ ভরে দেখব কত আলো-ছায়ার খেলা...। এই সেই পুকুর! ১৯৯০ সালে নতুন ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে কী? পুকুরের বয়স আড়াল করা যায়নি। চারপাশে সবুজ বৃক্ষ। বৃক্ষের ছায়া পড়ছিল পুকুরের জলে। সেই জল বলে দিচ্ছিল, বহুকালের সাক্ষী এই পুকুর। পুকুরটি ঘিরে কবির যেমন সুখস্মৃতি অনেক, তেমনি আছে বেদনাবোধ। আদরের ছোট ছেলে মতিন এই পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। মাত্র ১৩ বছরের কিশোর কোনদিন আর ভেসে ওঠেনি। পুত্র হারানোর শোক কবি সারাজীবন বুকে পুষে রেখেছেন। একাধিক কবিতায় সেই বিয়োগব্যথার কথা লিখেছেন। পুকুরের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতাটির কথা, যেখানে কবি লিখছেনÑ ‘বললাম-জিজ্ঞাসু অতিথিকে/এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই তখন/পাথরের টুকরোর মতন/ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে/বছর তিনেক আগে কাক ডাকা/গ্রীষ্মের দুপুরে...। পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে সামান্য এগোলে কবির পিতৃনিবাস। এখন জীর্ণ। পরিত্যক্তপ্রায়। এর পরও কবি পরিবারের আভিজাত্য তুলে ধরে চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা দালান বাড়ি। কেউ এখানে থাকেন না। অনেক দূরের সম্পর্কের একজন দেখাশোনা করেন। দেখাশোনাও নামমাত্র। বাড়ির বাইরের অংশে শেওলা জমে আছে। কোথাও কোথাও উঁকি দিচ্ছে বটগাছের চারা। এসবেই মন খুঁজে নেয় শামসুর রাহমানের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতৃনিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন কবি। সে সময় সম্পর্কে তার বলাটি এ রকমÑ ‘আমার বাবা তাঁর জমিতে একটি মাঝারি দালান তৈরি করেন। নিজের জন্মস্থানের প্রতি অত্যন্ত টান ছিল বলেই বেশ খরচ করে চারদিকে দেয়ালঘেরা বাড়িটি বানিয়েছিলেন তিনি। এই বাড়ি তৈরির ব্যাপারটি ঢাকা শহরে ভূমিষ্ঠ এবং ক্রমাগত শহুরে হয়ে ওঠা তরুণ আমি কোন যুক্তিসঙ্গত মনে করিনি। কিন্তু একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিন পেরুনো রাতে বাবার দূরদর্শিতা উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতায় আবার নতুনভাবে হৃদয় প্লাবিত হলো। তিনি এখানে দালানটি না বানালে মহাবিপদের কালে মধ্যরাতে কোথায় ঠাঁই পেতাম। বাড়ির গেইট-এর চৌকাঠ পেরুতেই নাকে এলো বেলফুলের সুগন্ধ এবং মনে হলো আমার প্রয়াত পিতা, পিতামহ, মাতামহ আমাকে প্রশস্ত বুকে টেনে নিলেন। আগুন, গুলির অবিরাম আওয়াজ, পানিতে ভাসমান লাশ, আতঙ্ক থেকে দূরে শান্ত, নিরুপদ্রব পাড়াতলীতে দেড় মাস কাটানো গেল।’ বাড়িটি শামসুর রাহমানকে আশ্রয় দেয়নি শুধু, উপহার দিয়েছিল দুটি অমর কবিতা। একটি ‘স্বাধীনতা তুমি’। অন্যটি ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমানের কবিতার বিপুল ভা-ার। কিন্তু এই দুই কবিতা ছাড়া তিনি অসম্পূর্ণ। বাংলা সাহিত্যেও কবিতা দুটি অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে এবং এখানেই কবিতা দুটি একসঙ্গে লেখা হয়। হঠাৎ করেই কবি খাতা-কলমের জন্য দৌড়ে ঘরের ঢোকেন। তার পর মুখস্থের মতো লিখে যানÑ স্বাধীনতা তুমি/রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা...। একই সময়ে একই বসায় তিনি লেখেনÑ তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্য/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?/তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর...। যমজ কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন, ‘এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক দুপুরে বাড়ির প্রায় গা-ছোঁয়া পুকুরপাড়ে গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। তখনও দ্বিপ্রাহরিক আহার করিনি। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কয়েকটি শব্দ খেলে গেল আমার মগজের কোণে। আমি এক লহমায় উঠে পড়ে ছুটে গেলাম আমার এক শতায়ু চাচার ঘরে। সেখান থেকে কাগজ এবং একটি পেন্সিল চেয়ে নিয়ে ফিরে গেলাম পুকুরপাড়ের সেই গাছতলায়। প্রায় এক ঘণ্টায় দুটি কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতা দুটির নাম রাখলাম ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। এই কবিতা দুটিকে আমার যমজ কবিতা বলতে ভাল লাগে। পাড়াতলীতে থাকার সময় এই দুটি কবিতাই লিখতে পেরেছিলাম। এর বেশি একটি পঙ্ক্তিও লিখতে পারিনি দেড় মাস।’ তবে অভাবনীয় ইতিহাসের সাক্ষী পাড়াতলী এখন ভাল নেই। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের যুগেও বিদ্যুত আসেনি গ্রামটিতে। কবির বাসার সামনে রাজধানী থেকে আসা মানুষের উপস্থিতি দেখে অনেকেই ছুটে এলেন। তাদের কণ্ঠে আক্ষেপ। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, শামসুর রাহমানের মতো কবির জন্ম যে গ্রামে, সেই গ্রাম নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের কারও কোন আগ্রহ নেই। বিদ্যুতটাও আমরা পেলাম না। বিপুল টাকায় সোলার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের আলো শামসুর রাহমান। এই আলো সারাদেশে জ্বলছে। আমরা অন্ধকারে! লোকমুখে কবির নাম থাকলেও গ্রামের কোন স্থাপনায় শামসুর রাহমান নামটি পাওয়া গেল না। স্বাধীনতার কবিতা দুটিও উৎকীর্ণ করা নেই কোথাও। বিকেলে কবি পরিবারের সদস্যরা নিয়ে গেলেন একটি স্কুলের সামনে। বিশাল মাঠের পাশে একটি ছোট একতলা ভবন। এটি কবির নামে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি গ্রন্থাগার। দেখে ভাল লাগছিল। কাছে যেতেই মন বিষণœ হয়ে গেল। ভেতরে কোন বই নেই। চেয়ার-টেবিল শূন্য। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানালেন, ২০০৯ সালে সরকারী অর্থায়নে কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি গ্রন্থাগার নির্মিত হয়। এর পর থেকে দীর্ঘ সাত বছরে এটি চালু করা যায়নি। জনবল নিয়োগ করা হয়নি। কোন বইপত্রও নেই। স্কুল ভবনটি কবি পরিবারের জায়গায় নির্মিত। এর পরও সেখানে কবির কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে যে পুরনো ধুলো জমা ফ্রেম সেখানে খুঁজে পাওয়া গেল শামসুর রাহমানকে! ঢাকায় ফিরে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, কে এই ধুলো ধুয়েমুছে পরিষ্কার করবে? করবে কি?
×