ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাড্ডায় নিজামীর স্ত্রীর স্কুল জামায়াতের আস্তানা, গ্রেফতার ১৮

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২০ আগস্ট ২০১৬

বাড্ডায় নিজামীর স্ত্রীর স্কুল জামায়াতের আস্তানা, গ্রেফতার ১৮

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে দেশব্যাপী চলমান সাঁড়াশি অভিযানে একের পর এক আবিষ্কৃত হচ্ছে জঙ্গী আস্তানাসহ সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠান। শুক্রবার রাজধানীতে পৃথক অভিযানে বাড্ডার ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে ১৮ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এবং গে-ারিয়া থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ঢাকা কলেজের এক ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। বাড্ডার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী পরিচালনা করেন। এই নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের অন্তত অর্ধশত আস্তানা আবিষ্কৃত হলো। আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয়েছে কয়েক শ’ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও জঙ্গী। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও জঙ্গী কর্মকা-ে ব্যবহৃত নানা আলামত। তারপরও থেমে নেই জঙ্গী তৎপরতা। শুক্রবার ভোরে বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ৮ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর ছয়তলা বাড়ির তৃতীয় ও ষষ্ঠ তলায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। বাড্ডা থানার ওসি এমএ জলিল জানান, শুক্রবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বরাবরই বন্ধ থাকে। কিন্তু ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গোপন বৈঠক চলছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে বৈঠকরত অবস্থায় গ্রেফতার হয় ১৮ জন। গ্রেফতারদের মধ্যে বাড্ডা থানা জামায়াতে ইসলামীর আমির ফখরুদ্দিন কেফায়েত উল্লাহও রয়েছেন। পাশাপাশি ফখরুদ্দিনের স্ত্রী ও দুই মেয়ে এবং বাড়ির মালিক বেলাল হোসেনের স্ত্রী ও মাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয়েছে। ওসি বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকা- নিয়ে আগাগোড়াই সন্দেহ ছিল। এজন্য বহুদিন ধরেই নজর রাখা হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটির ওপর। যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী মোছাঃ শামছুন্নাহার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ। পাশাপাশি তিনি জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগেরও সেক্রেটারি জেনারেল। ঘটনার সময় তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। বিধি মোতাবেক বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন কিনা তা জানতে বাড়ির মালিক বেলাল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একটি শাখা গুলশানে এবং অন্যটি মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত। দুটি শাখারই অধ্যক্ষ মোছাঃ শামছুন্নাহার নিজামী। গ্রেফতারকৃত বাড্ডা থানা জামায়াতে ইসলামীর আমির ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ কেফায়েতুল্লাহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রিন্সিপাল। মূলত তিনিই সরেজমিনে উপস্থিত থেকে বাড্ডার শাখাটি পরিচালনা করে আসছিলেন। ছয়তলার ওপর থাকা এক?টি চিলেকোঠায় পরিবার নিয়ে বাস করছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল। স্কুলটিতে প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকিমশনার এসএম মোস্তাক আহমেদ খান জানান, বন্ধের দিন কি উদ্দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গোপন বৈঠক করছিল আটকদের সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে শুক্রবার দুপুর দুটার দিকে পবিত্র জুমার নামাজের পর রাজধানীর গে-ারিয়া মসজিদের সামনে দেশে ইসলামী শাসন কায়েমের বক্তব্য সংবলিত রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণের সময় গ্রেফতার হয়েছে দুই ছাত্র। গে-ারিয়া থানার ওসি কাজী মিজানুর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃত হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ছাত্র। অপরজন জাহিদুল ইসলাম ঢাকা কলেজের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ছাত্র। তাদের কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট উদ্ধার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এর পর থেকেই দেশে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ব্লগার, প্রকাশক, লেখক থেকে শুরু করে সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় একে একে হত্যাকা-ের শিকার হন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রকৌশলী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপ, প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চ্যাটার্জী নিলয়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন, নাজিম উদ্দিন সামাদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক। জঙ্গী হামলায় আহত হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, প্রকৌশলী তারেক রহিম, রন দীপ বসুসহ অনেকে। আহত অনেকেই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। সর্বশেষ গুলশানে ১৭ বিদেশী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জনকে হত্যা এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে হামলায় বাধা দিতে গিয়ে জঙ্গীদের হাতে নিহত হন দুই পুলিশ সদস্য। জঙ্গীদের নৃশংস হামলার প্রেক্ষিতে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানে একের পর এক আবিষ্কৃত হচ্ছে জঙ্গী আস্তানা ও সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠান। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে দুটি জঙ্গী আস্তানা আবিষ্কৃত হয়। আস্তানা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় আল আনসার নামের একটি নতুন জঙ্গী সংগঠনের সমন্বয়কসহ পাঁচজন। আর পুলিশের অভিযানে আবিষ্কৃত হওয়া জঙ্গী আস্তানা থেকে জিহাদী বইপত্রসহ ১৪ শিবির নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। চলতি বছরের জুলাইতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি জঙ্গী আস্তানা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ছাত্র শিবিরের ১৯ নেতাকর্মী। জুলাইতে টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকার আউচপাড়ার একটি জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক বিদেশী পিস্তল, ১৩৩ রাউন্ড তাজা বুলেট, ৩টি কমান্ডো নাইফ (জেএমবির ভাষায় নান চাকু), ৩টি ছুরি, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি চাপাতি, ৭টি হ্যান্ডগ্রেনেড, ১৩টি ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটর, ৭টি পাওয়ার জেল, ২ কেজি পটাশিয়াম, আধাকেজি সোডা, ১টি ডামি টার্গেট, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম এবং জিহাদী বইপত্র। গ্রেফতার হয় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির এক সমন্বয়কারীসহ চারজন। গত ১৫ আগস্ট র‌্যাব চারটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে জেএমবির নারী শাখার চার উচ্চশিক্ষিত জঙ্গীকে। যাদের মধ্যে একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক। বাকি তিনজন জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্র্সিটির ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী। গ্রেফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্রীত্ব বাতিল করেছে। এছাড়া চলতি বছর বাড্ডার সাঁতারকুল ও মোহাম্মদপুরে জঙ্গীদের দুটি বড় আস্তানার সন্ধান মেলে। আস্তানায় অভিযানকালে জঙ্গী হামলায় আহত হন এক পুলিশ কর্মকর্তা। আস্তানা দুটি থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও হ্যান্ডগ্রেনেড, সসপ্যান বোমা, টেনিস বল বোমাসহ মারাত্মক সব অস্ত্র, গোলাবারুদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে জেএমবি, হিযুবত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ও হুজির তৎপরতা রয়েছে। নিষিদ্ধ বাকি সংগঠন জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও শাহাদাৎ-ই-আল-হিকমার প্রকাশ্য কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
×