ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

অনশন ভাঙলেন লৌহমানবী ইরম শর্মিলা

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৯ আগস্ট ২০১৬

অনশন ভাঙলেন লৌহমানবী ইরম শর্মিলা

পনেরো বছর আট মাস এগারো দিন। প্রায় ষোলো বছর পর ভারতের লৌহমানবী ইরম চানু শর্মিলা অনশন ভেঙেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, মণিপুরের নির্বাচনে লড়বেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে রাজ্যকে আফস্পা মুক্ত করবেন। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে মণিপুরবাসীর সমর্থন চেয়েছেন শর্মিলা। কারণ তিনি জানেন যে কোন দাবি আদায়ে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেকে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। যেমন চর্যাপদের কবিদের দ্রোহ থেকে কৈবত্য বিদ্রোহ। ফকির বিদ্রোহ থেকে ফরায়েজী আন্দোলন। বাঁশের কেল্লা নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তিতুমীর। কলের বোমা হাতে ক্ষুদিরাম বসু। চট্টলার সেনাপতি সূর্য সেন, প্রীতিলতা। ব্যারাকপুরের ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মঙ্গল পা-ে। বিনয় বাদল-দিনেশ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু। আজকের স্বাধীন ভারতে মণিপুর রাজ্যে অফস্পা প্রয়োগের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে লড়াই করে এক সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে শর্মিলা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। তাঁর এই অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে। ৪৪ বছরের এই নারীকে এমন একটি আইনে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, যাতে আত্মহত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থা, সশস্ত্র হিংসার দীর্ঘ পরম্পরায় দীর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্ব। সেই ভুখ-ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অনন্য নজির রাখলেন শর্মিলা। মণিপুর পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা পায় ১৯৭২ সালে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিতে থাকে এই রাজ্যে। সেই সূত্র ধরেই ‘সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা ) আইন ১৯৫৮ বা অফস্পা প্রয়োগ। গুরুতর অভিযোগ উঠতে থাকে এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়েও। ২০০০ সালের ২ নবেম্বর মালোম বাসস্ট্যান্ডে ১০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে জঙ্গী সন্দেহে হত্যা করার প্রতিবাদে এবং আফস্পা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সেই বছরই ৪ নবেম্বর থেকে অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সব থেকে ছোট শর্মিলা মায়ের কাছে শপথ করেছিলেন, আফস্পা যতদিন প্রত্যাহার না হবে, ততদিন বাড়ি ফিরবেন না, মায়ের মুখও দেখবেন না। কিন্তু গত ২৬ জুলাই অনুগামীদের পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে আদালতে হঠাৎ শর্মিলা ঘোষণা করে বসেন, তিনি অনশন ভাঙতে চান। বিয়ে করতে চান। লড়তে চান ২০১৭ সালের নির্বাচনে। ইরম শর্মিলার আগেও অনেক অনেক রকম পথে আন্দোলন করতে শিখিয়েছেন মণিপুরকে। সে সব পথের অনেকগুলোই সহিংস, সশস্ত্র, প্রাণঘাতী। ইরম শর্মিলা যে দিন সেই পথে না হেঁটে, অহিংস এবং গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই দিনই গণতন্ত্রের এক বিরাট জয় সূচিত হয়েছিল মণিপুরে। দীর্ঘ ষোল বছর মণিপুরের প্রশাসন তাকে বন্দী রেখে এবং বলপূর্বক তরল আহার দিয়ে আন্দোলন রুখে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বে¡ও শর্মিলা যেভাবে স্বপথে অবিচল থেকেছেন, তাতেও শোনা গিয়েছে গণতন্ত্রের জয়গান। শর্মিলা কিন্তু আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসেননি। কৌশল পরিবর্তন করেছেন মাত্র। কৌশল পরিবর্তন যে কোন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে শর্মিলার এই অনশন ভঙ্গের সঙ্গে একটি নাম বার বার উঠে আসছে তা হলো শর্মিলার প্রেমিক, ব্র্রিটিশ নাগরিক ডেসমন্ড কুটিনহোর নাম। ২০১১ সালে যখন শর্মিলা প্রথম প্রকাশ্যে জানান তিনি প্রেমে পড়েছেন, তার সহকর্মীরা কেউ ভালভাবে নেননি এমনকি তার পরিবারও। অনশন প্রত্যাহারের সঙ্গে এক নিশ্বাসে উচ্চারণ বিয়ে করে সংসার করার কথা, আরও জোরদার হয়েছে সেই গুঞ্জন। ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘বানিং ব্রাইট’ বইটি লেখার সময় শান্তি আন্দোলন কর্মী দীপ্তিপ্রিয়া মেহরোত্রা একাধিক সাক্ষাতকার নেন শর্মিলার। শর্মিলা খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, একমাত্র নিজের শরীরটার ওপরেই সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার, আর তাই সেই শরীরকে তিনি ব্যবহার করেছেন আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে। নিজের শরীর সর্ম্পকে এই স্বাধিকারবোধ প্রথম থেকেই একেবারে স্পষ্ট ছিল শর্মিলার কাছে, যে কারণে অনশনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কারও সঙ্গে পরামর্শ করেননি তিনি। এমনকি নিজের পরিবারের সঙ্গেও নয়। নারী শরীরের স্বাধিকার প্রসঙ্গটি মণিপুরের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সন্দেহ নেই, সবার সঙ্গে থেকেও একা হয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা। যে পথ তিনি নিয়েছিলেন তাতে অবশ্য একা হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তার অভিজ্ঞতা একান্তভাবেই তারই, যতই তার সঙ্গে থাকুন, এই ভয়ানক দীর্ঘ পথ আর কেউ পাড়ি দেননি। শুধু তার সহকর্মীরা কেন, শর্মিলা যে অবস্থানে পৌঁছেছেন গত ১৬ বছরে, আর কোন মানুষ এ যাবতহ ততটা এগোয়নি। কে জানে, শর্মিলার বন্ধুরা হয়ত ভুলেই যাচ্ছিলেন যে তিনি মানুষই, দেবী নন? আর ঠিক সেই কারণেই শর্মিলার অনশন ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত, তার অনশন শুরুর সিদ্ধান্তের মতোই সদর্থক।
×