ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ॥ এক রানীর গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৯ আগস্ট ২০১৬

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ॥ এক রানীর গল্প

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। চট্টগ্রামের বিপ্লবী, অগ্নিকন্যা যাকে সবাই রানী নামেই ডাকত। বিশ শতকের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকের অগ্নিঝরা দিনগুলো যাদের আত্মদানে স্মরণীয় হয়ে আছে, প্রীতিলতা তাদেরই একজন সহযোদ্ধা, বিপ্লবী, দেশমাতৃকার জন্য আত্মবলিদানে বিজয়ী এক নারী। বিশ শতকের সূচনা লগ্ন থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সারা বাংলা এবং পুরো ভারতে যে মুক্তিসেনারা বিপ্লবের আর বিদ্রোহের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশের সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেদের মূল্যবান জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন তারা আজও আমাদের কাছে নমস্য, স্মরণীয় এবং বরণীয় ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশবিরোধী এই আন্দোলনের প্রথম দিকের অন্যতম দিক পাল মাস্টারদা সূর্যসেন। তারই অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রামজুড়ে যে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে তা সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এই বিপ্লবী সংগঠনের আর এক কৃতী পুরুষ পূর্ণেন্দু দস্তিদার। যিনি রানী বা প্রীতিলতার সম্পর্কে খুড়তত ভাই। পারিবারিক এবং সামাজিক আবহ তৎকালীন অনেক উদীয়মান কিশোরী-কিশোরীকে উদ্বুদ্ধ করে এই অগ্নিস্নাত বিপ্লবের কাতারে নিজেদের দাঁড় করাতে। কাছ থেকে প্রীতিলতা এসব বিপ্লবীকে দেশের প্রতি মমত্ববোধ এবং সংগ্রামী কর্মযজ্ঞ দেখে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন। ভাবতে থাকেন কিভাবে নিজেকেও এসব দুঃসাহসিক অভিমানে একাত্ম করতে পারবেন। ইতোমধ্যে ‘ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই’-এর জীবন কাহিনী পড়া হয়ে যায় প্রীতিলতার। এই ঝাঁসির রানীও প্রীতিলতার অনুপ্রেরণাকারীদের অন্যতম। বাংলা তথা সর্বভারতে ব্রিটিশবিরোধী যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় এসে পড়ে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যে বিপ্লবী সংগঠনটি তৈরি হয় চট্টগ্রামে, প্রথম দিকে এই দলে কোন মেয়ে সদস্য ছিল না। সৎ, মেধাবী, আদর্শ নিষ্ঠ ও সাহসী ছাত্রদের নিয়ে এই বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অনেক মেয়েও এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে। তখন বাংলা তথা সারা ভারত উত্তাল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে। পরাধীন দেশকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে কতিপয় সাহসী তরুণ এই সম্মুখ-সমরে নিজেদের জীবনকে সাহসী তুচ্ছজ্ঞান করে। দেশের এই ক্রান্তিকালীন অবস্থায় প্রীতিলতা তার শৈশব- কৈশোর পার হয়ে যৌবনের উদ্দীপ্ত সময়ে নিজেকে নিবেদন করলেন সংগ্রামী চেতনায়। বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে অকুতভয় বিপ্লবীরা, সাহসী যোদ্ধারা তার মানসপটে বিভিন্নভাবে রেখাপাত করতে থাকেন। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভাদেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। অত্যন্ত মেধাবী এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তিতে পারদর্শী প্রীতিলতার স্কুল জীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত ডাঃ খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুলের মাধ্যমে। ষোলো বছর বয়সে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করলেন প্রথম বিভাগে। এর পরে ভর্তি হন ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজে। এখানেও কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করেন তিনি। মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে নিজের অসামান্য সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। এর পরে চলে যান কলকাতায় বিএ পড়ার জন্য। ইংরেজী সাহিত্যে বিএ পড়ার জন্য ভর্তি হন বেথুন কলেজে। স্কুলে পড়ার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় আর এক বিপ্লবী কল্পনা দত্তের। ইডেন কলেজে এসে যুক্ত হন নারী বিপ্লবী লীলা নাগের সঙ্গে। আর এসবের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে তার সাংগঠনিক বিধিনিষেধ অনুধাবনের মাধ্যমে এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের অনুমতিক্রমে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে এক সময়ে নিজেকে একেবারেই সম্পৃক্ত করে নেন। বেথুন কলেজ থেকে উচ্চ ডিগ্রী নেয়ার পর শুরু হলো তার পেশাগত জীবন। তিনি চট্টগ্রামের এক বিখ্যাত স্কুল, অপর্ণা চরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসেবে তার কর্ম জীবন শুরু করেন। কিন্তু সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হওয়ার কারণে ব্রিটিশ রাজ শক্তির রোষানলের শিকার হলেন। অতঃপর তার ওপর পুলিশী নজরদারিও বাড়তে থাকে। নিজের দক্ষতা এবং সক্ষমতা প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ে বিপ্লবী কর্মকা-ের অনেক গুরু দায়িত্ব। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের সফল হয়েও নিজের জীবনকে আহুতি দিতে হয় অকাতরে, নির্দ্বিধায়। এমন সাহসী, বিপ্লবী, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা আজও আমাদের কাছে দেশপ্রেমের এক উদ্দীপ্ত দৃষ্টান্ত।
×