ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নারী শিক্ষার গোড়া পত্তনের প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১৯ আগস্ট ২০১৬

নারী শিক্ষার গোড়া পত্তনের প্রেক্ষাপট

আমাদের বাংলাদেশের নারীদের শিক্ষাঙ্গনে অনুপ্রবেশের ইতিহাস জানতে গেলে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষার সূচনা এবং বিকাশ। প্রাচীন ভারত থেকে আজকের বাংলাদেশ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় যে আধ্যাত্মিকতার খোলস এবং পাশ্চাত্য ভাবধারা তা আজও আমাদের জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে ঘিরে রেখেছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক এবং সর্বশেষে উচ্চশিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে দেশবাসীকে দীর্ঘসময় পার করতে হয়েছে। একদা আধ্যাত্মবাদের দেশ বলে খ্যাত ভারতের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা আচ্ছন্ন। ব্রিটিশকা নিজেদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে এদেশে একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী প্রথমে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিতে চায়নি। ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে দেখা যায়, ১৭৮১ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এবং ১৭৯১ সালে জোনাথন ডারকান কর্তৃক কাশীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং জাগতিক ভাবধারাকে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে চায়নি ইংরেজ শাসক। তারপরও ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ইংরেজ ভারতে তথা ভারত সাম্রাজ্যের বাংলা প্রেসিডেন্সিতে তখন থেকেই শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার গোড়া পত্তন হয়। মিশনারীদের উদ্যোগে ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ এবং ১৮২০ সালে কলকাতা বিপস কলেজ স্থাপিত হয়। কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয় ১৮২৪ সালে এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয় ১৮৩৬ সালে। সমসাময়িককালে অর্থাৎ ১৮৩৫ সালে ঢাকায় স্থাপিত সরকারী বিদ্যালয়টিকে কলেজে উন্নীত করে নাম দেয়া হয় ঢাকা কলেজ। পুরো শিক্ষাব্যবস্থার এই ঐতিহাসিক পটভূমি ছাড়া নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচনের বিষয়টি কোনভাবেই আনা যাবে না। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে উল্লেখ থাকে, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক শ্রেণী তৈরি করবে যারা চিন্তা চেতনায় পুরোপুরি ইংরেজ হবে আর রক্তেমাংসে থাকবে ভারতীয়। ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত উপমহাদেশের প্রথম স্নাতক সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ‘স্বাধীনতা’ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন- ‘স্বাধীনতা দেশী কথা নহে, বিলেতী আমদানি, লিবার্টি শব্দের অনুবাদ- ইহার এমন তাৎপর্য নয় যে, রাজাকে স্বদেশীয় হইতে হইবে (নরহরি কবিরাজ)। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে ব্রিটিশ প্রবর্তিত যে শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে তা ছিল মূলত ধর্মীয় চেতনা দ্বারা আবিষ্ট। সমসাময়িককালে নারী শিক্ষা কোন পর্যায়ে ছিল কিংবা আদৌ ছিল কিনা সেটাও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়। ব্রিটিশ ভারতেই যথার্থভাবে নারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। প্রথমেই ইংরেজ মিশনারিদের উদ্যোগে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর পর্যন্ত সমস্ত সমাজ সংস্কারক নারী শিক্ষার ওপর জোরালো মত দিতে থাকেন। সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে কোন সমাজ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না। এই বোধে শিক্ষিত ভদ্রলোকরা নারী শিক্ষার পথ অবারিত করার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করলেন। রবার্ট মে নামে একজন ইংরেজ মিশনারী ১৮১৮ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টিই মেয়েদের জন্য স্থাপিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চার্চ মিশনারী সোসাইটির পৃষ্ঠপোশকতায় মিস মেরি এ্যান কুক ১৮২৩ থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে অন্তত ৩০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ঠিক এই সময়ে শ্যামবাজার অঞ্চলের একজন মুসলমান মহিলা মিস কুকের দিকে তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এই মহিলা নিজে বাড়ি ঘুরে ঘুরে মুসলমান ছাত্রীদের খুঁজে নিয়ে আসতেন। যে সময় মুসলমান পুরুষরাই আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে ততখানি অগ্রসর হতে পারেননি সেখানে একজন অশিক্ষিত মুসলিম নারীর শিক্ষার জন্য এ ধরনের মহৎ উদ্যোগ সত্যিই যুগের অগ্রগামী কর্মযোগ। কিন্তু মিশনারী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্কুলে সেভাবে নারী শিক্ষার দ্বার অবারিত হয়নি। কারণ ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা এসব বিদ্যালয়ে পড়তে যেত না। ভদ্রলোকের মেয়েদের জন্য প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পুরো কৃতিত্ব বেথুন এবং বিদ্যাসাগরের। বেথুনের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও সদিচ্ছার সঙ্গে মুক্ত হয় বিদ্যাসাগরে অনমনীয় দৃঢ়তা এবং সাহসী পদক্ষেপ যার ফলশ্রুতিতে ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বেথুন গার্লস হাইস্কুল। তৎকালীন কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের বেথুন স্কুলে পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। খ্রিস্টান মিশনারীরা আমাদের বাংলাদেশেও বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত কাজে অব্যাহত রাখেন। এসব বিদ্যালয় মূলত বাইবেল শিক্ষা দেয়া হতো। ফলে কোন ভদ্রঘরের মেয়েরা এসব স্কুলে পড়তে যেত না। কাছাকাছি সময়ে রাজশাহীতে ১৮৬৮ সালে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের নজির পাওয়া যায়। রাজশাহীর পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত এক বালিকা বিদ্যালয়ের নাম পাওয়া যায় যা বর্তমানে পিএন গার্লস স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৬৮ সালে দুটি বালিকা বিদ্যালয়ের সন্ধান রাজশাহীর বিভিন্ন নথিপত্রে পাওয়া যায়। একটি মিশন কর্তৃক পরিচালিত অপরটি সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত। সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়টি দীঘিপাতিয়ার জমিদার পিএ রায় বাহাদুর রাজশাহী জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে ৬৩০০ টাকা এই বিদ্যালয় চালানোর জন্য একটি দানপত্র হস্তান্তর করেন। ১৮১৭ সালে ঢাকায় মিশনারীদের উদ্যোগে প্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে ছেলেদের পাশাপাশি ২/১ জন মেয়েও পড়তে যেত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮২৫ সালে মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় খোলা হয়। এই সালেই ঢাকায় বালক-বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টি এবং ৫২১ জন ছাত্রের বিপরীতে ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৯ জন। তবে কলকাতার মতো ঢাকার সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরাও এসব স্কুলে পড়তে যেত না। ফলে বেথুনের মতো ঢাকায়ও স্থাপিত হলো ভদ্রঘরের মেয়েদের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয়। আমাদের বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখে ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইডেন গার্লস হাইস্কুল। যা নারী শিক্ষার নিমিত্তে তৎকালীন প্রশাসকদের একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল। বাংলার গভর্নর স্যার এ ইডেন ঢাকায় এই বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষা এবং নারী শিক্ষার ইতিহাসও ঢাকার সমসাময়িক। জামাল খাঁ রোডে অবস্থিত ডাঃ খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুল এক প্রাচীন বালিকা বিদ্যালয়। এটি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভার্নাকুলার মিডল স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে উন্নীত হয়। চট্টগ্রামে মুসলিম নারী শিক্ষা একটু দেরিতেই হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামেও মিশনারীদের স্কুলে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা পড়তে যেত না। ১৯১৩ সালে ইব্রাহীম কন্ট্রাক্টর নিজ গ্রামে মেয়েদের জন্য একটি প্রাইমারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নিজের তিন কন্যাকে ঐ স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে চট্টগ্রামে যথার্থ মুসলিম নারী শিক্ষা শুরু হয় যখন ১৯২২ সালে আম্বিয়া খাতুন নামে এক মহীয়সী নারী ‘চন্দনপুরা মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে গুলজার বেগম গার্লস হাইস্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে। আর এটাই চট্টগ্রামে আধুনিক নারী শিক্ষার যাত্রা শুরু। নারী জাগরণ এবং নারী শিক্ষার পথিকৃত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। ভাই-বোনের সহযোগিতা এবং পরবর্তীতে স্বামীর অনুপ্রেরণাই তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন। প্রথম থেকেই বেগম রোকেয়া অনুধাবন করেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির কোন মুক্তি আসবে না। আর তাই নিজের ক্ষুরধার লেখনীকে যেদিন শাণিত সুযোগ পান সেদিন সবার আগে তার সামনে এসে দাঁড়ায় এ দেশের ভাগ্যহত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত নারী সমাজ। তিনি শুধু নারী জাতিকে পথনির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বাস্তব কর্মসূচীও হাতে নিয়েছেন নারী শিক্ষার দ্বার খুলে দিতে। তার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলটি কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় বালিকা বিদ্যালয়। এর আগে কলকাতায় মুসলিম বালিকাদের জন্য দুটো বিদ্যালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। কলকাতায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়টি ১৮৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব বেগম ফেরদৌস মহলের পৃষ্ঠপোশকতায় স্থাপিত হয়েছিল। ১৯০৯ সালে স্থাপিত হয়েছিল মুসলমান মেয়েদের জন্য দ্বিতীয় বালিকা বিদ্যালয়। সোহরাওয়ার্দী বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রসিদ্ধ মুসলিম বাঙালী নেতা সোহরাওয়ার্দী মাতা সমাজকর্মী খুজিস্তা আখতার বানু। এছাড়াও তিনি বস্তি এলাকায় দরিদ্র জনসাধারণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিজে ছিলেন সুশিক্ষিত। পিতার কাছে আরবী, ফার্সী, উর্দু ও ইংরেজী শিখেছিলেন। উপমহাদেশের মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকও ছিলেন তিনি (বাংলা বিশ্বকোষ, ২য় খ-, পৃ-২৬০)। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অবিভক্ত বাংলার নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হলেও মুসলিম নারীর ক্ষেত্রে এ পথ সহজ-সরল ছিল না। ধর্মীয় অনুশাসন, অবরোধ প্রথার করাল নিষ্পেশন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কঠিন শৃঙ্খলকে অতিক্রম করে নারীদের শিক্ষা তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা ছিল সত্যিই কষ্টসাধ্য। সেই পর্বতপ্রমাণ বাধাকে নারীরা এক সময় জয় করেছে, শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে, পেশাগত জীবনে তাদের অবস্থান সংহত করেছে। ঘরে-বাইরে নারীরা ক্রমান্বয়ে তাদের আসন মজবুত করার সংকল্পে আজও লড়াই করে যাচ্ছে।
×