ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এপিজির খসড়া প্রতিবেদন ;###;দুদকের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ;###;এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব

সন্ত্রাসী অর্থায়নের ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৯ আগস্ট ২০১৬

সন্ত্রাসী অর্থায়নের ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ!

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের (এপিজি) মিউচুয়াল ইভালুয়েশনের খসড়া প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশকে ‘লো’ ক্যাটাগরি দেয়া হয়েছে। এ কারণে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় এপিজির ১৯তম বৈঠকের আগে সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বুধবার বিকেলে সচিবালয়ে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ, বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, আইজিপি শহিদুল হক, ড্রাফটিং বিভাগের সচিব শহীদুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর উপস্থিত ছিলেন। ‘এপিজি’ হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স (মানিলন্ডারিং) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থার (এফএটিএফ) আঞ্চলিক সংস্থা। এর কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনী দুর্বলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করা। ১৯৮৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সংস্থাটি মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে আসছে। অর্থপাচার-জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের (এপিজি) ১৯তম বার্ষিক সম্মেলন এবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগোতে অনুষ্ঠিত হবে ৫-৮ সেপ্টেম্বর। এ সম্মেলন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা যুক্তরাষ্ট্রে নেয়া হয়। সম্মেলনটি যুক্তরাষ্ট্রে করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে এপিজির কাছে আবেদন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই আবেদন গ্রহণ করেছে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত এপিজির প্রধান কার্যালয়। এপিজির প্রতিবেদনে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ তদন্তে আর্থিক গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহারের ঘাটতি, এ্যাটর্নি জেনারেল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্ষমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে। এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের লোকবল স্বল্পতা ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ও রেটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় অনুষ্ঠেয় এপিজির ১৯তম বার্ষিক সভায় এটি অনুমোদনের জন্য উঠানো হতে পারে। এর আগে এসব বিষয়ে উন্নতির পাশাপাশি খসড়া প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে না পারলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের। এপিজির খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ সময় পাচ্ছে মোটের ওপর ১৭ দিন। এপিজির বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন ড্রাফটিং বিভাগের সচিব শহীদুল হক। এর আগে আগামী তিনদিনের মধ্যে এপিজির সুপারিশগুলো ড্রাফটিং বিভাগে দেবে। ড্রাফটিং বিভাগ সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করে ১০ দিনের মধ্যে তা অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা জানতে গত বছরের ১১-২২ অক্টোবর পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শন করে এপিজি। পরিদর্শনের পর এপিজি একটি খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি আমেরিকায় অনুষ্ঠেয় এপিজির বার্ষিক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রতিবেদনটিতে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ৪০ সুপারিশের বিপরীতে ১৪টিতে পার্শিয়ালি কমপ্লায়েন্ট (পিসি), ২০টিতে লার্জলি কমপ্লায়েন্ট (এলসি) এবং ৬টিতে কমপ্লায়েন্ট (সি) রেটিং দেয়া হয়েছে। এ রেটিংগুলো উন্নত দেশের সমতুল্য। কোন কোন ক্ষেত্রে তা উন্নত দেশগুলো থেকেও ভাল। কিন্তু সমস্যা বেধেছে ১১টি ইমিডিয়েট আউটকামের (আইও) ১টিতে সাবস্টেনশিয়াল, ৬টিতে মরডারেট এবং ৪টিতে ‘লো’ লোভেল রেটিং দেয়ায়। বিশেষত যে ৬টিতে মরডারেট রেটিং দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্ততপক্ষে ২টি রেটিংয়ে উন্নতি করা না গেলে বাংলাদেশ আবার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকাভুক্ত হতে পারে। পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপে (আইসিআরজি) হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেগুলোতে বাংলাদেশকে মরডারেট রেটিং দেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ে অভাব। প্রতিবেদনে এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের লোকবলের স্বল্পতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছে। জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম গ্রহণের স্বল্পতা, মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ তদন্তে আর্থিক গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহারের ঘাটতি রয়েছে বলে এপিজির খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রেটিং উন্নতি করতে বিএফআইইউ, দুদকসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিবেদনে দুদকের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এপিজি। দুদকের অক্ষমতার জন্য বাংলাদেশকে ‘লো’ ক্যাটাগরি দেয়া হয়েছে। বৈঠকে এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে দুদককে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠকে বলা হয়েছে, এপিজির খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনে যেসব বিষয়ে রেটিং কম এসেছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদফতরসহ কয়েকটি সংস্থা একযোগে কাজ করলে সার্বিক বিষয়ে উন্নতি করা যাবে। এতে একদিকে যেমন রেটিং ভাল আসবে, আবার অন্যদিকে মানিলন্ডারিংয়ে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হবে। এছাড়া এপিজির বার্ষিক সভায় গুলশান ট্র্যাজেডির জের ধরে জঙ্গী ও জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টি বাংলাদেশকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। বৈঠকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জঙ্গী মোকাবিলায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি ফিরিস্তি তুলে ধরতে হবে। এটি এপিজির বার্ষিক সভায় উপস্থাপন করা হবে। ফিরিস্তিতে মানিলন্ডারিং, সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স মনোভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হবে। পাশাপাশি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন অগ্রগতির একটি রূপরেখাও এপিজি বৈঠকে তুলে ধরা হবে।
×