ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

আলোকচিত্রে দৃশ্যমান একাত্তরে জেগে ওঠা লন্ডন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৯ আগস্ট ২০১৬

আলোকচিত্রে দৃশ্যমান একাত্তরে জেগে ওঠা লন্ডন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সময়টা তখন উত্তাল। চলছে বাঙালীর স্বাধীনতার সংগ্রাম। দেশকে স্বাধীন করতে লড়াই করছে রণাঙ্গনের মুক্তিসেনারা। সে সময় দেশের বাইরেও যেন জেগে উঠেছে লন্ডনের হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নার। মুক্তিকামী প্রবাসী জনতার সমাবেশে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। মুখে গণহত্যা বন্ধের সেøাগান আর হাতে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই ছবিটির মতো মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের অনবদ্য ভূমিকার সাক্ষ্যবহ অনেকগুলো ছবি এখন ঠাঁই পেয়েছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। সেসব ছবি মনে করিয়ে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই হয়নি। রাজনীতির মাঠেও হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। দেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও স্বাধীনতার সমর্থনে হয়েছে প্রতিবাদ ও সভা-সমাবেশ। এই ভূখ-ের বাইরেও স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াইয়ের সেসব দিনগুলো উঠে এসেছে ‘লন্ডন ১৯৭১ : ভিন দেশে বাঙালীর আগুনঝরা দিনের গল্প’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। বৃহস্পতিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ এর আয়োজনে শুরু হয়েছে তিন দিনের এ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশিরভাগ ছবি ব্রিটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েন ও বিরেতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা। এছাড়া রয়েছে বেশকিছু সংগৃহীত ছবি। গত আট বছর ধরে লন্ডনে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে এসব ছবি সংগ্রহ করেছেন উজ্জ্বল দাশ। এছাড়া লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজী সংবাদপত্রের মূলকপি, পোস্টার, ডাকটিকেট ও প্রেচারপত্র স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে। বাঙালীদের পাশাপাশি একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গঠনে ব্রিটিশ এমপি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণীর মানুষ রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে সেসব ভিনদেশী বন্ধুদেরও ছবি। এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আলোচনায় অংশ নেন ১৯৭১ সালে লন্ডনে স্থাপিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শহীদ সন্তান ড. নুজহাত চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা উজ্জ্বল দাশ। প্রদর্শনী প্রসঙ্গে উজ্জ্বল দাশ বলেন, এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ বাঙালী প্রজন্মকে একাত্তরে ভিন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভূমিকাটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। এটাই আমাদের প্রথম প্রদর্শনী এবং এ ছবিগুলো এর আগে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে প্রদর্শনীটি সিলেট এবং লন্ডন ও বার্মিংহামে এ ছবিগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভিনদেশে বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে গড়ে ওঠা প্রবাসী ও লন্ডনবাসীর সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা বিক্ষোভের ছবি। একাত্তরের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফের হাতে আঁকা ঐতিহাসিক পোস্টারটি স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এসব ছবির মধ্যে আছে একাত্তরের লন্ডনের হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নারে মুক্তিকামী জনতার সমাবেশ। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে বিভিন্ন পোস্টার ও তাঁর ছবি প্রদর্শন করছেন বিক্ষোভকারীরা। এসব সমাবেশে বাঙালীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন বিলেতবাসীও। দেখা মেলে একাত্তরের ৪ জুন তারিখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট্রের দিকে এগিয়ে চলেছে ইউকের মহিলা সমিতির দুর্বার মিছিল। একাত্তরের পহেলা আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দেখা মেলে একটি ছবিতে। আছে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সরাসরি পৌঁছে যান লন্ডনে। সেখানের ক্লারিজ হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন জাতির জনক। তখন চলছে তুমুল গতিতে। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালীদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিটিও মান বাড়িয়েছে প্রদর্শনীর। প্রদর্শনী শেষ হবে শনিবার। জাতীয় চিত্রশালার ৫ নম্বর গ্যালারিতে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী খোলা থাকবে বিকেল তিনটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত। শিল্পকলায় সেলিম আল দীন উৎসব ॥ রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা নাটকের নতুন আলোর দিশারী সেলিম আল দীন। পশ্চিমা নাট্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেছেন হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্য নিয়েছে। বাংলা নাটকে প্রবর্তন করেছেন বর্ণনাত্মক ধারা। নাট্যতত্ত্ব নির্মাণের পাশাপাশি দ্বৈতাদ্বৈতবাদিতার আলোকে লিখেছেন বেশ কিছু কালজয়ী নাটক। বৃহস্পতিবার ছিল বরেণ্য এই নাট্যকারের ৬৭তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে শুরু হলো তিন দিনব্যাপী উৎসব। শিশুদের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ও নাট্য প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজনে বর্ণময় হয়ে ওঠে উৎসব। উদ্বোধনী আয়োজনে খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী রাইসুল ইসলাম আসাদকে প্রদান করা হয় সেলিম আল দীন পদক। ‘তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ’ সেøাগানে যৌথভাবে উৎসবের আয়োজন করে ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে উৎসব উদ্বোধন করেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। এ সময় তিনি বলেন, সেলিম আল দীনের সৃজনশীল জীবনটা জুড়ে ছিল এই ভূখ-। শিল্প নির্মাণে তিনি শিকড়ের সন্ধান করেছেন। বাংলা নাটক তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার কাছে মনে হয় তাঁর জীবনটা একটা অসমাপ্ত গানের মতো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম সদস্য কামাল বায়েজীদ। পদকপ্রাপ্ত রাইসুল ইসলাম আসাদের জীবনী পাঠ করেন শিমুল ইউসুফ। রাইসুল ইসলাম আসাদের হাতে পদক তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তৌফিক হাসান ময়না। বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার বাছাইকৃত ছবি নিয়ে নাট্যশালার লবিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রদর্শনী। সন্ধ্যায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পদক প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা শেষেমঞ্চস্থ’ হয় ঢাকা থিয়েটারের নাটক নিমজ্জন। সেলিম আল দীনের রচনা থেকে প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এ আগে সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীনের সমাধিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বিকেলে শিল্পকলার নাট্যশালার লবিতে অনুষ্ঠিত হয় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে জাহাঙ্গীরনগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের নাটক ‘কারবালার জারি’। মীর মশাররফ হোসেনের রচনা থেকে প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন রেজা আরিফ। শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনের সন্ধ্যায় শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে পরিবেশিত হবে ‘পুতুল তোমার জনম কি রূপ’ শীর্ষক সেলিম নাট্যমঞ্জুরি। ঢাকা থিয়েটার পরিবেশিত প্রযোজনাটিতে এক চরিত্রাংকন করবেন শিমুল ইউসুফ। স্বপ্নদলের সেলিম আল দীন জন্মোৎসব ॥ সেলিম আল দীনের ৬৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁরই নাট্য-ঐতিহ্যের ধারক নাট্যসংগঠন স্বপ্নদল বৃহস্পতিবার থেকে শনিবারপর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করেছে তিনদিন ব্যাপী ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মোৎসবÑ২০১৬’। নাট্যাচার্যকে নিয়ে স্বপ্নদলের আয়োজনে ১৪তম এ উৎসবের স্লোগানÑ ‘ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙলা নাট্যের স্বর্ণালী দিন, প্রেরণা মোদের রবীন্দ্রনাথ সঙ্গী সেলিম আল দীন’ এবং উৎসবটি উৎসর্গ করা হচ্ছে সংস্কৃতিজন প্রয়াত রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের স্মৃতির প্রতি। উৎসবের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যাচার্যের সমাধি অভিমুখে স্মরণ-শোভাযাত্রা ও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ। সন্ধ্যায় এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রয়াত রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের সহধর্মিণী শেলী সেনগুপ্তা। এরপর মঞ্চ¯’ হয় জাহিদ রিপনের নির্দেশনায় বাঙলা নাট্যরীতিতে নির্মিত সেলিম আল দীনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘হরগজ’। আজ শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় স্টুডিও থিয়েটারে থাকবে অরব্য রজনীর ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ অবলম্বনে জাহিদ রিপনের কাহিনি পুনর্বিন্যাস ও নির্দেশনায় বাঙলা মূকাভিনয়রীতিতে নবরূপে নির্মিত মূকনাট্য (মাইমোড্রামা) জাদুর প্রদীপের প্রদর্শনী। উৎসবের সমাপনী শনিবার বেলা সাড়ে ৩টায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার/মহড়া কক্ষে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের সভাপতিত্বে একক বক্তৃতানুষ্ঠানে ‘সেলিম আল নাট্যদর্শন তথা বাঙলা নাট্যরীতি প্রসারে প্রতিবন্ধকতা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক বক্তব্য করবেন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান।
×