ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও ১০ নারী জঙ্গীর নামধাম প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ আগস্ট ২০১৬

আরও ১০ নারী জঙ্গীর নামধাম প্রকাশ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ চার নারী জঙ্গী গ্রেফতারের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাড়তি গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান দুটির শিক্ষক ছাড়াও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত বলে তদন্তকারীদের ধারণা। আর এদের মাধ্যমেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন করে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটছে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গীবাদে। ধৃত চার নারী আরও দশ নারী জঙ্গীর নাম প্রকাশ করেছে। তারাও কোন না কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে পারে। প্রকাশ পাওয়া দশ নারীর নামগুলো ছদ্মনাম কিনা সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চলছে। গত ১৫ আগস্ট র‌্যাব-৪ এর অভিযানে ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গ্রেফতার হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশি (২৩), জামায়াতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ (২২), খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা (২৩) ও আকলিমা রহমান ওরফে মনি (২৩)। তাদের কাছ থেকে জিহাদী কর্মকা- চালানোর নানা ধরনের বহু আলামত উদ্ধার হয়। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সূত্র বলছে, আটক চার নারী জঙ্গী দশ নারী জঙ্গীর নাম প্রকাশ করে। তারা হচ্ছে সাফিয়া ওরফে সানজিদা ওরফে ঝিনুক, মাইমুনা ওরফে মাহমুদা ওরফে লায়লা, তাসনুবা ওরফে তাহিরা, সায়লা ওরফে শাহিদা, সালেহা ওরফে পুতুল, দিনাত জাহান ওরফে নওমী ওরফে বানী, তানজিলা ওরফে মুন্নী, আলিয়া ওরফে তিন্নি ওরফে তিতলী, মনিরা জাহান ওরফে মিলি ও ছাবিহা ওরফে মিতু। এ দশ জনকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও নতুন জেএমবিতে আরও কিছু মহিলা সদস্য রয়েছে। তাদের নাম জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক লুৎফুল কবির জানান, মামলাটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। যে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার নারী জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান দুটিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নজরদারি অব্যাহত আছে। এজাহারনামীয় অপর দশ নারীর বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চলছে। তদন্ত সূত্র বলছে, নতুন প্রকাশ পাওয়া দশ নারী জঙ্গীও কোন না কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হতে পারে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। উচ্চ শিক্ষিত নারীর জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষক বা উর্ধতন কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। ওসব শিক্ষক বা কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের মদদের কারণেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গীবাদ নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এসব শিক্ষক বা কর্মকর্তার পেছনে বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থায়ন করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গীবাদের ধারাটি ওয়ানওয়ে। এখানে একবার ঢুকলে বের হওয়া কঠিন। অনেকটা আসক্তির মতো। পাশাপাশি কেউ জঙ্গীবাদ থেকে বের হয়ে গেলে, তার প্রাণনাশেরও আশঙ্কা থাকে। কয়েক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল উত্তরায়। জেএমবি থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল রাশেদুল। সে ঢাকার একটি মসজিদে ইমামতি করত। পাশাপাশি জেএমবি ও জঙ্গীবিরোধী বয়ান করত। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে প্রকাশ্যে উত্তরায় ছুরিকাঘাতে ও গলা কেটে হত্যা করে জেএমবি সদস্যরা। তদন্ত সূত্রগুলো বলছে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্ধতন পর্যায়ে একজন জঙ্গী আদর্শে বিশ্বাসী হলে তার সংস্পর্শে আসাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে। তার উৎকৃষ্ট নজির বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। তিনি নব্বই দশকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। সেখানে তিনি হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারির কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত আবার পুরনো কর্মস্থলে ফিরে আসেন। এসেই যোগাযোগ শুরু করেন সমমনা শিক্ষক, ছাত্রসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে। এই শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ও একটি এনজিওর পলিসি এনালিস্ট শেখ তৌফিকসহ সমমনাদের। পরবর্তীতে শেখ তৌফিক ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। তার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়টির বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। শুধু জঙ্গীবাদ নয়, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক প্রকৌশলী রাজিব হায়দার শোভন হত্যা থেকে শুরু করে সর্বশেষ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টার ঘটনায়ও নর্থ সাউথ বিশ্বববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকের জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ২০০২ সালে একটি এনজিওর উত্তরা কার্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র, কাজী মোরশেদুল হককে যুগ্ম সমন্বয়কারী, অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা সিনিয়র উপদেষ্টা, বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ তৌফিককে রাজনৈতিক উপদেষ্টা করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোল টেবিল বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক এই জঙ্গী সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনের নিজস্ব ঘাঁটিতেই হিযবুত তাহরীরকে দলীয় কার্যক্রম চালানোর জন্য অফিস খুলে দিয়েছিল। শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ সব সরকারী-বেসরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিযবুত তাহরীর কার্যক্রম চালু করে। সংগঠনটির নারী শাখার প্রধান ছিলেন ফাহমিদা ফারহানা খানম। জঙ্গী সংগঠনটির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের সহযোগী হিসেবে কাজ করা, ২০০২ সালে ডেনমার্কে ইহুদী দেখামাত্র হত্যার ঘোষণা দেয়া, ২০০৩ সালে তেলআবিবে এক মদের দোকানে বোমা হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানের মার্কিন ও ইসরাইলী দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৪ সালে তাজিকিস্তানের তাসখন্দে বোমা হামলা করে ৪৭ জনকে হত্যা ছাড়াও আল কায়েদা, তালেবান ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য কর্মী সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩ দেশে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরা আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, আনসার আল ইসলাম, নতুন জেএমবিসহ নানা জঙ্গী সংগঠনের নামে তৎপরতা চালাচ্ছে। যাদের নতুন জেএমবির অনেক সদস্যই হিযবুত তাহরীর থেকে আসা। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য জেএমবির আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে এক উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেএমবি সদস্যদের প্রায় শতভাগই ছাত্রশিবির থেকে আসা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন অনেক আগেই হয়েছে। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তা অতিমাত্রায় বিস্তার লাভ করেছিল। সেই পুরনো নেটওয়ার্কের সূত্র ধরেই এখনও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা চলছে। হালে সেই চেষ্টাকে সহজ করে দিয়েছে ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি। জঙ্গীরা প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় দু’চারজন গ্রেফতার হলেও বেশিরভাগই গ্রেফতারের বাইরে থাকছে। তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করায় তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
×