ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পলিয়ার ওয়াহিদ

মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৯ আগস্ট ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান

‘জল জোছনায় নাজমুল’ মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার লড়াকু জীবন গাথা। যিনি কিনা অকুতোভয়ে আমরণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তির! মাত্র বাইশ বছরের এই ন ম নাজমুল আহসান কীভাবে যুগযুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার দীর্ঘ জীবন আখ্যান কখনও গল্পের বুননে। কখনও উপন্যাসের ঢঙে। তুলে ধরেছেন নিপুণ আর অসম্ভব যত্ন আত্তির মাধ্যমে। শ্রদ্ধা আর সম্মান মাখান আছে ‘জল জোছনায় নাজমুল’ বইটার প্রতিটি লাইনে। প্রতিটা পৃষ্ঠায়। নাজমুল আহসানের প্রতি অশেষ প্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধই নিশ্চয়ই এই কঠিন কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে লেখককে। যা সত্যিই অত্যন্ত ত্যাগ ও শ্রমসাধ্যের ব্যাপারও বটে। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন কতটা বর্ণিল আর উদ্যমতায় ভরপুর, কত স্মৃতি আর কত সংগ্রামে মুখর। সেই জীবন শুদ্ধ ও নিখুদ এবং পরিপাটি রূপে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন আবদুস সামাদ ফারুক। সরকারের উচ্চপদে থেকেও এমন দুরূহ কাজে হাত দেয়ায় লেখকের প্রতি পাঠকের চোখ কৃতজ্ঞায় ভরে ওঠে। মাথা নত হয় নাজমুল আর তার মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার নজির দেখে। যারা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তাদের না দেখা চোখ নতুন করে দেখবে পাবার মতো বর্ণনায় জমাটবাঁধা ‘জল জোছনায় নাজমুল’। যেন পাঠক নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। কখনও কখনও এমনই মনে হয়! মুক্তিযুদ্ধের তত্ত্ব উপাত্তে ভরা এমন বই লেখা যে চাট্টিখানি কথা নয় তা বইটি দেখলেই সহজেই অনুমীয়! বইটি যদিও মুক্তিযুদ্ধের তবু তার পাতায় পাতায় কাব্যকময়তা। কারণ বইটি যাকে নিয়ে লেখা তিনিও একজন কাব্যকার। আবার যিনি লিখেছেন তিনিও কাব্য জ্ঞানের আঁধার। প্রথমে একটা বাধ্য-বাধকতায় বইটা হাতে নিই। আবিষ্কার করি মুক্তিযুদ্ধের মনি-মুক্তার খনি। একটা অজানা ইতিহাসের পাতায় চোখ আটকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধা দাদা-দাদির কাছে। কাকা আব্বা তখন একেবারে ছোট। কত গল্প-উপন্যাস পড়েছি। কত নাটক-সিনেমা দেখলাম। কিন্তু এই বইয়ের প্রেক্ষাপট যেন একেবারে আলাদা। একেবারে আদি ও আসল। মূল ঘটনা বলতে গিয়ে অনেকে যেভাবে ছায়া গল্পে ঢুকে পড়ে। এই বইটি তেমন নয়। একেবারে খাঁটি আর সত্য গল্পে ভরপুর। কোথাও মুখ্য বিষয় নিয়ে দূরে থাকার চেষ্টা করা হয়নি। বাস্তব সত্য ও একনিষ্ঠ বর্ণনা পাঠকের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। যেন প্রত্যেক পাঠকই যোদ্ধা। আর অমানুষিক কর্মকা-ে অংশ নেয়া সেইসব আলবদর-রাজাকারদের কখনও ক্ষমা করতে পারব না। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার। সেখানে পুরো বইটার একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। আবদুস সামাদ ফারুক মূলত কবি। বইটা বীর মুক্তিযোদ্ধা ন ম নাজমুল আহসানের জীবন, কর্ম, বেড়ে ওঠা, তার শৈশব, কৈশর, লেখাপড়া, রাজনীতি, সর্বোপরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং শাহাদাতবরণ করা পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং সতর্কতার সঙ্গে কুশলি কায়দায় উপস্থাপন করেন। ঠিক গল্প নয়। আবার প্রবন্ধও তাকে বলা যায় না। না তা ঠিক নিউজ কিংবা ফিচারও না। যেন গবেষণালব্ধ ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। তার ভেতরে ভেতরে গল্পের গন্ধ, উপন্যাসের চরিত্রের মতো ঢুকে পড়েছে নাজমুল নামের নায়ক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নুরুন্নবী মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বা ন ম নাজমুল আহসান এক কিংবদন্তি নাম। তিনি ২০ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে শেরপুরের লালিতাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সেকান্দার আলী তালুকদার ও মা নূরজাহানের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে নাজমুল সবার বড়। সে ছিল মা-বাবা ও বংশের সবার চোখের মনি। রূপকথার নায়কের মতো এখনও তাঁকে নিয়ে গল্প, বহু ঘটনা এবং স্মৃতিচারণ লালিতাবাড়ির মানুষের মুখে মুখে বেড়ায়। অপরূপ মুখশ্রীর এক বালকের অসাধারণ মেধার উন্মেষ বিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দিয়েই। ১৯৬৫ সালে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিপ্রকৌশলী ও কারিগরি অনুষদে ভর্তি। পরিবাররে মাধ্যমে সাহিত্য পাঠে অভিষেক। নিজেই গল্প কবিতা নাটক লিখে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে উজ্জীবিত। তাছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, ক্রীড়াঙ্গনেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। ষাদের দশকের শেষ পর্বে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের হাওয়া তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারপর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। বইটির সূচী চারটি পর্বাকারে ভাগ করেছেন লেখক। প্রথম পর্বের শিরোনামÑ ‘যে জীবন বয়ে গেছে ভোগাইয়ের স্রোতে, মিশে আছে শিশির স্নিগ্ধতার ব্রহ্মপুত্রে’। দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম- ‘মুক্তির যুদ্ধ ও নাজমুল’ মুক্তিযদ্ধের সূচনাকাল। তৃতীয় পর্বের শিরোনাম- ‘ভালবাসার শিশিরে স্নাত নাজমুল আহসান’। চতুর্থ পর্বের শিরোনাম- ‘স্মৃতির আয়নায় নাজমুল’।
×