ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম পাটওয়ারী

বেদনার নীল উপাখ্যান

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৯ আগস্ট ২০১৬

বেদনার নীল উপাখ্যান

সম্প্রতি কথাশিল্পী মাসুদ আহমেদের ‘বিজন নীল জলে’ উপন্যাসটি পড়ার পর মনে হয়েছে লেখন এবং পঠন দুটিই কখনও কখনও নিঃসীম বেদনার। উপন্যাসটি আমাদের কথাসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি স্মারক চিহ্ন যা আগাগোড়া দুঃখবোধে তাড়িত। উপন্যাসের শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে শুরু করেছেন লেখক- ‘এই সব গুরুতর কথা সহজে বিশ্বাস হইতে চায় না।’ এরপর পুরো উপন্যাসের শরীরজুড়ে আছে বিশ্বকবির অমোঘ উপস্থিতি, কখনও গানে কখনও পঙ্ক্তিতে। লেখক নিজ জবানিতে বলেছেন- আমার এই উপন্যাসে জাতির জনকের একজন হত্যাকারীর ক্রম পরিণতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে পাঠক পাঠিকারা এতে সব সময় যেন ইতিহাস না খোঁজেন, সে অনুরোধ করব। সাহিত্য আর ইতিহাসে পার্থক্য থাকবেই। আইনস্টাইনও বলেছেন, সাহিত্যের কাজ সত্যকে উপস্থিত করা নয়, বরং সত্যের কাছাকাছি কিছুকে উপস্থিত করা। আমি সে চেষ্টা করেছি। মলাটের ভাঁজে বইটি নিয়ে যে ধারণা কথন আছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার কোন খলনায়ককে নিয়ে এমন উপন্যাস আর রচিত হয়নি। তবে এর উপজীব্য রাজনৈতিক নয়। তা নৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক। লেখক তাঁর উপন্যাসটি শুরু করেছেন নায়ক বা খলনায়ক যাই বলি না কেন তার পিতার সরকারী চাকরির মধ্যগগণ থেকে, যখন ১৯৪৮ এর এপ্রিল মাস। দেশভাগের নানা উপাদান, সম্পত্তি বিনিময়, সীমান্ত পাড়ি দেয়া, অপশন দিয়ে এপার-ওপারে চলে যাওয়া সবকিছুর একটি ইঙ্গিতসহ সময়কে এগিয়ে নিয়ে উপন্যাসটির যাত্রা শুরু হয়েছে। পিতা যেহেতু সামরিক চিকিৎসা সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন ফলে কার্য উপদেশে নানা স্থানে বদলি হয়েছেন আর সে জনপদগুলোর নিসর্গ, মানুষের কৃষ্টি ইত্যাদি উঠে এসেছে। বাবা সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে পুত্রও লালন করেছেন সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন। এভাবেই একসময় সত্য (উপন্যাসের নায়ক) একদিন সামরিক কর্মকর্তা হয়ে এদেশের ইতিহাসের খলনায়ক হয়ে ওঠেন। শুরুতেই পিতার অমোঘ বাণী- এই প্রফেশনে প্রশ্নহীন আনুগত্য সবচেয়ে বড় বিষয়। এটিকে চরম নেতিবাচকভাবে চেতনার সূক্ষ্ম তারে জড়িয়ে নিয়েছেন সত্য। এই প্রশ্নাতীত আনুগত্য তিনি কার প্রতি নিবেদন করেছিলেন তা সময়ের বাতাবরণে আলোচিত হয় রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে তরতর করে তা এগিয়ে যায়। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলবদের ভূমিকা, নানা ঘটনা প্রবাহের তথা দৃশ্যপটের বর্ণনা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, এরশাদ প্রমুখের বিবিধ বিষয় নানা উপলক্ষে উঠে এসেছে। এখানে মূল ঘটনার অনুপঙ্খ বিবরণ যেমন আছে তেমনি আছে একটি সময়কে ধরে এগিয়ে যাওয়ার বিবর্তন। এই পথচলায় লেখক কখনও কখনও অতি দ্রুত এগিয়েছেন আবার কখনও বা ঘটনাক্রমের বর্ণনা এঁকেছেন ধীর লয়ে। আবার রাজনৈতিক স্পর্শ কাতরতা বিবেচনায় সতর্ক পদচিহ্ন রেখেছেন। লেখক এখানে রাজনীতির কূট আবহ এড়িয়ে ইতিহাসকেই গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনতে প্রয়াসী ছিলেন হয়তো। তবে এ উপন্যাস রচনা করতে যেয়ে লেখক এ বিশাল জনপদের সীমানা, ভূ-প্রকৃতি, সামরিক বাহিনীর নানা অনুষঙ্গ ইত্যাদি প্রকাশে শ্রমসাধ্য গবেষণা কাজও করেছেন। উপন্যাসের একস্থানে আছেÑ ভারতের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে কাশ্মীর, খেমকারান, ওয়াগাহ, বেদিয়ান-শকরগর, রাজৌরী, হোসাইনীওয়ালা, পুষ্ণ, ছাম্ব, জুরিয়ান, অমরকোট ও শিয়ালকোট শহর রয়েছে। উপন্যাসের দ্বাদশ অধ্যায়ের শুরুর অনুচ্ছেদটিতে অনবদ্য উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যা পূর্ববর্তী রাতের এক অসামান্য বর্ণনাÑ বৃহস্পতিবার। শ্রাবণ মাসের শেষরাত কিন্তু গত কয়েকদিনে বা রাতে আকাশের কোন কান্না ছিল না। তাই আকাশ পরিষ্কার। ভোরবেলা ধানম-ির সুনসান রাস্তা টিউবলাইটের আলোমাখা হালকা অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন। পূবের আকাশে এখনও রঙ ধরেনি। বাতাস মৌন, লেকের দিককার গাছগাছালিতে পাখিদের কলরব এখনও শুরু হয়নি। পরিবেশ প্রতিবেশের নিখুঁত বর্ণনার চিত্রনাট্যে যে ভাবগম্ভীর আবহ সৃষ্টি হয়েছে এরপরই ঘটেছে বাংলার ইতিহাসের জঘন্যতম রোমহর্ষক ঘটনা। লেখক নির্মোহে অতঃপর একে একে উল্লেখ করে গেছেন বেদনায় নীল হওয়া জলের পদাবলী। রাজনৈতিক প্রতিটা পট পরিবর্তনেই সত্যের আশা জেগে ওঠা, আবার স্মৃতি জাগানিয়া নানা পঙ্ক্তিমালা, স্মৃতি কাতরতা ইত্যাদি উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছাপ রেখেছে। এখানে কুশিলবদের অনেকের ছদ্ম নাম, কখনও বা সঠিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মূল নটনটীগণের ছদ্ম নাম উল্লিখিত হলেও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী পাঠকগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না পেছনের মানুষটির পরিচয়। বিচার প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে লেখক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এক গুরুগম্ভীর দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করেছেন যাতে কাব্যিক অনুষঙ্গ বর্তমান। উপন্যাসের মোট ৪৯টি অধ্যায়ের মধ্যে শেষ দুটি অধ্যায় লেখক চরম কুশলতায় আর আবেগে রচনা করেছেন। এখানে আলোচিত ঘটনার শুরু থেকে অভিযোগ দায়ের, মামলা থানা, আদালত, উকিল, জজ সাহেব সাক্ষী সবশেষে জল্লাদের মনস্তাত্ত্বিককতার বিবর্তন উঠে এসেছে। উপন্যাসটির অন্তিম পৃষ্ঠায় জেলার তৌহিদ রাত একটা পর্যন্ত চারজনের মহাপ্রস্থান নিশ্চিত করে যে স্বগতোক্তি করেছিল তা হলোÑ হায় ফারুক ইতিহাসে নাথুরাম গড্সে থাকবে না। থাকবে গান্ধীর নাম, তেমনই তুমিও থাকবে না । থাকবে এই জাতির স্থপতির নাম। তুমি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে ক্ষুদ্রতর করেছ নিজেকে। লেখক মাসুদ আহমেদ রচিত এ উপন্যাসটি সচেতন পাঠকের চেতনায় এক সূক্ষ্ম অনুরণন তোলে। অতঃপর তা প্রবাহিত হয় শিরা উপশিরায়। ইতিহাসনির্ভর এ উপন্যাসটি বহুল পঠিত হোক এই কামনা করি।
×