ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তা ফারজানা

গল্প ॥ সেপারেশন পেপারটা এখনও বালিশের নিচেই

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১৯ আগস্ট ২০১৬

গল্প ॥ সেপারেশন পেপারটা এখনও বালিশের নিচেই

দুটো ছায়া। পাশাপাশি চলছে। জানুয়ারি মাস। অদ্ভুত শীত। ঘন রাত। তুলার মতো জমাট বাঁধা কুয়াশা। সামনে-পেছনে-ডানে-বামে ধোয়াটে দৃষ্টি ওঠান। রাস্তার ধারে বেড়ে উঠা গাছেদের বুকে শিশির জমে আছে। কখনও ঝরে পড়ছে টুপ-টাপ। প্রচ- ঠা-া। আকাশের বুকে ঝুলে থাকা চাঁদটাও হয়তো বরফ জমে যাবে। ছায়া দুটো কাঁপছে। সময় বিরতি দিয়ে কখনও কখনও ছুটে চলে বাস-ট্রাক। সেইসব রাত জাগা যানবাহনের আলোয় ছায়া দুটো দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে বেড়ে যায় মাঝে মাঝে। বাড়তে বাড়তে মিশে যায় কুয়াশা জমা অন্ধকারে। হারিয়ে যায়। তারপর অস্পষ্ট হয়ে উঠে ফ্লাড-লাইটের নিয়ন আলোয়- আবারও। ফার্মগেট ব্রিজ। দিনের আলোয় ছুটোছুটি এই মোড়টা রাত গভীরেও শান্ত নয়। এ কোন সে কোন থেকে নাইট-গার্ডদের চলমান আওয়াজ শোনা যায়। থেকে থেকে প্রতিধ্বনিত হয় তীক্ষè হুইসেল। এত শীতেও ফুটপাথে ঘুমন্ত রাত কাটায় ধুলোয় আশ্রিত মানুষগুলো। টুকরো কাপড় সম্বল করে পার করে দেয় দীর্ঘরাত। কেউ কেউ ঘোর স্বপ্নে মাখামাখি হয়ে নড়তেও ভুলে যায়। ফুটো কাঁথায় উঁকি মারে হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস। কখনও কুয়াশাছন্ন রাত কেঁটে কেঁটে ভেসে আসে ছটফটে শিশুকান্না। তোলপাড় করে মায়ের ঘুমন্ত শরীরে। ব্রিজের গোড়ায় কখনও রংচঙে সোয়েটার পরিহিত নারীদেহ দেখা যায়। ওরা দলছুট হেঁটে চলে এলোমেলো শরীরে। কান পাতলে ব্রিজের ওপর বাজতে থাকা ফিসফাসও শোনা যাবে হয়তো; চোখ পাতলে কড়া ধোয়া কু-লীও দেখা যাবে। এরা নিশাচর। ক্লান্ত দেখায় চলমান ছায়া দুটোকে। অসমান। একটা ছায়া দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে চওড়া এবং প্রশস্ত। অন্য ছায়াটি সরু-ছোট। খিদে পেয়েছে... কিছু একটা খাওয়া দরকার। ছোট ছায়াটিকে দুর্বল দেখাচ্ছে। বড় ছায়াটি হাঁ-না জবাব দেয় না। হাঁটতে থাকে। -আরে বাবা... দাঁড়ান না একটু। কোথায় যান? হেঁটে হেঁটেই কি রাত শেষ করে দেবেন? ছোট ছায়াটির কণ্ঠে বিরক্তি ফুটে উঠে। বড় ছায়াটি থেমে যায়। ছায়া দুটোর মাঝে কিছু দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বড় ছায়াটি ছোট ছায়াটির কাছে এসে দাঁড়ায়। -কী খাবেন? বেশ খিদে পেয়েছে ছোট ছায়াটির। উশ-খুশ করতে থাকে। উত্তরের অপেক্ষা করে না। চলেন ভাত খাই। ছোট ছায়াটিকে অনুসরণ করতে থাকে বড় ছায়াটি। বেশ অবাক লাগছে। এত রাতে কোথায় পাবে ভাত! কে জানে! ওরা হাঁটতে হাঁটতে কাওরান বাজারের গলিতে ঢুকে পড়ে। ওখানে সারিবদ্ধ বাস-ট্রাক। কোন কোন ট্রাকে মাল ওঠানো-নামানোর কাজ চলছে। লালচে ধুলায় মাখামাখি এখানকার বাতাস। সামনেই একটা ভাতের হোটেল। লোকাল। ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত রাত জাগা ড্রাইভারদের জন্য। ছায়া দুটো ভেতরে গিয়ে বসে। ভেতরটা উত্তপ্ত। গমগমে। মানুষগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কারও বা আবার গরম চায়ে ডোবানো পুরি ত্যানা ত্যানা হয়ে যায়। কেউ আবার দলগত ঠাট্টা আলাপের রেশ তুলে ওদের দেখে। ছায়া দুটো নির্বিকার। বিশেষ করে বড় ছায়াটি। প্রচ- শীতল দৃষ্টি ওর। যেন কিছুই যায় আসে না। ছোট ছায়াটি অবশ্য একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কারণ- অসম পরিবেশ। তবুও, এখানে তো ওরা থাকতে আসেনি। পেটে ক্ষুধা। খেয়েই চলে যাবে। -মামা, কী আছে খাওয়ার? পনেরো ষোল বছরের একটা ছেলে রোবোটের মতো করে সীমিত খাদ্য তালিকা মুখস্থ করে। মুরগি, রুই মাছ, ভাত আর ডাল ফ্রি। সবজি নাই? উত্তরে মাথা নাড়ে ছেলেটা। উস্... মুরগি কত? তিরিশ ট্যাকা, ভাত ছয় টাকা প্লেট। ঠিক আছে দুইটা ভাত আর একটা মুরগি ...দাও। দুই/তিন মিনিট পরেই খাবার সামনে রেখে যায় ছেলেটা। ছোট বাটিতে কাঁচামরিচ আর দুইটা কাঁচের গ্লাস দিয়ে যায়। -ঐ মামা গ্লাসগুলো একটু ধুইয়া দাওনা। গরম পানি দিয়া ধুইয়ো। মাথা কাৎ করে চলে যায় ছেলেটা। ছোট একটা স্টিলের বাটিতে দুই পিস্ মাংস আর টলটলে লালচে ঝোল। যত ছোট করে সম্ভব ততো ছোট করে কাটা পিস্ দুটো। ছোট ছায়াটি বাটিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এই ধরনের হোটেলে মরা মুরগি রান্না করে খুব সম্ভবত...। আচ্ছা পাল্টে মাছ নেবে নাকি? মামা... ডাক দিতে গিয়েও চুপ মেরে যায়। কেননা এখানে মাছ ঠিকমতো পরিষ্কারও করে না, ধোয়ও না। সময় কোথায় অত! যাক্। মুরগিই চলুক। ছোট ছায়াটি এক টুকরো মাংস আর ঝোল নিয়ে বাকিটা বড় ছায়ার দিকে ঠেলে দেয়। ভাতে লবণ মাখাতে মাখাতে বলে- দেখেছেন লবণের বাটিতে কত্তো ময়লা। আর এই জগটা দেখেন। হাজার বছর ধোয়ইনি। এরা যে এত্তো ব্যস্ত থাকে কী আর বলার...। বড় ছায়াটি বলে না কিছুই। শুধু ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাড়ে, নাড়ে। ছোট ছায়াটি বলতেই থাকে, খাচ্ছেন না কেন? খান না। এসব খেয়ে অভ্যাস নাই বুঝি! খুবই স্বাভাবিক। আমার ও কোথায়... তবে আমি মাঝে মধ্যে রাস্তা ঘাটে অবশ্য খাই। খান খান। ম্যালামাইনের বাটিতে ডাল। চামচ দিয়ে ডাল নাড়তে নাড়তে আবার বলে, ডাল তো না যেন ওয়াশার পানি। ফ্যাকাশে রং আর অদ্ভুত ধরনের পাতলা। পারলে এরা ডাল ছাড়াই হলুদ-মরিচ সিদ্ধ পানি দেয়। অধের্কটা ভাতে ঢেলে চিবোতে চিবোতে আবার বলে- থাক, ফ্রিই-তো দেয়। না? এটলিস্ট এই পাথর দানার মতো শক্ত মোটা চালগুলো গলা বেয়ে তো নামছে। খাওয়া শেষ করে ওরা আবার হাঁটতে শুরু করে। এফডিসির কোণ দিয়ে রেললাইনের ওপর উঠে যায়। হঠাৎ করে গরম জায়গা থেকে বের হবার পর শীতটা যেন জেঁকে বসে। বড় ছায়াটি গায়ের শালটা ভালভাবে জড়িয়ে নেয়। একটু উষ্ণতার খোঁজে কিংবা মনের অজান্তেই ছোট ছায়াটি পাশ ঘেঁষে আসে। ঠা-া বাতাস চারদিকে। চাঁদটা মেঘের কোলে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। নীরব অন্ধকার। লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে পুরো শহর। বাতাসের দোলায় উড়তে থাকে বড় ছায়াটির চুল। কখনও এলোমেলো হয়ে লুটিয়ে পড়ছে কাঁধে, কখনও দুলে দুলে মুখে এসে পড়ছে। কখন যে খোপা খুলে গেছে হয়তো খেয়ালই করেনি। ছোট ছায়াটি আড় চোখে তাকায়। মেয়েটার চোখ দুটো বড় বড়, বাদামি, মায়াময়। বুচি নাকি, মোটা ঠোঁট, গোল চেহারা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। চওড়া গড়ন। ছড়ানো কাঁধ। দৃঢ় পদক্ষেপ। মেয়েটার চেহারা এবং দৈহিকতায় একটা লাবণ্য আছে; অন্যরকম ডাল লাগে। সেই গাবতলী বাজার থেকে হাঁটছে দুজনে। মেয়েটা তেমন কোন কথাই বলেনি। তাই সেও সেভাবে তাকানোর প্রয়োজনই মনে করেনি। এখন তার দিকে তাকাতেই একটা অচেনা অনুভূতি ঝাপটা মেরে যায়। -কী ব্যাপার? ক্লান্ত হয়ে গেছেন? ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে মেয়েটা। হঠাৎ অনাকাক্সিক্ষত কিন্তু অপ্রকাশিত প্রসঙ্গ শুনে চমকে উঠে নীল। -না-না তো...। হেসে নেয় একটু। অবাক হচ্ছি আরকি। আপনি এতো হাঁটতে পারেন! বোধহয় হেরেই গেছি আজ। তার কথার খেয়ায় হেসে উঠে মেয়েটা। -কেন! কেন! প্রতিযোগিতা চলছিল নাকি! -হুম... গন্তব্যহীন...। এক প্যাঁচের খোপায় বেঁধে নেয় চুলগুলো মেয়েটা। যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। গায়ে জড়ানো সবুজ শালটা নেড়ে চেড়ে নেয় আবার। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতও বাড়ছে। গাবতলী বাজারের একপাশ দিয়ে হাঁটছিল মেয়েটা। ধূসর অন্ধকারের ছায়ায়। হাঁটছিল খুব ধীরে ধীরে। নোয়ানো মাথা- মাটির দিকে। পোশাক-পরিচ্ছেদ, গতি-পরিধি শ্লীলতার পরিচয়ে মোড়ানো ছিল। তাই নেতিবাচক কিছু ভাবতে মন সাড়া দেয়নি। বরঞ্চ সে ভেবেছিল বোধহয় কোন সমস্যা কিংবা বিপদে থাকতে পারে মেয়েটা। তাই কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর পায়নি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। রহস্য রহস্য ভাব। তাছাড়া মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে! মনে করতে পারল না। ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগল। মিরপুর এলাকাতেই বড় হয়েছে নীল। স্থানীয় স্কুল-কলেজ শেষে এখন ভার্সিটির সিড়িতে। অদ্ভুত যে কোন কিছুর পেছন লেগে থাকাই তার ছোটবেলার স্বভাব। রাত-দুপুরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা, বাইনোকুলার নিয়ে ছাদে বসে থাকা, ঝুপ বৃষ্টিতে অন্ধকারের সঙ্গে খেলতে ভাললাগে তার। কলেজ জীবনে তো ভূত-শিকারের নেশা ছিল। ভীষণ। কোন পরিত্যক্ত, উদ্ভট ঘরবাড়ির অস্তিত্ব পেলেই ছুটে যেত। আর স্কুল জীবনে ক্লাস এইটে থাকতে তো গোয়েন্দা গিরির চেষ্টা চালিয়েছিল...রীতিমতো জেমস্ বন্ডের খালাতো ভাই। ক্লাস এইটে সেই মোটা ছেলেটার বাবা নাকি কোমড়ে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তার নাকি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসায় আছে! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এসেছিল সেবার। মাকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন প্রিন্সিপাল স্যার। আর বাসায় ফিরে সেকি মাইরটাই না পড়েছিল পিঠের ওপর... যাক্। ছায়া দুটো হাঁটতে থাকে। রেললাইনের ওপর দিয়ে। বিশাল বিলবোর্ড টাঙ্গানো; লাইনটা চলে গেছে মেইন রোডের ওপর দিয়ে। মগবাজার রেললাইন। দিনের আলোতে যেমন অস্থির, রাতের আলোতে তেমনই স্থির। সকালের সোনালি সূর্যে এই রেললাইনে চলে খোলা মাদক ব্যবসা। ৩০০/৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয় পুরিয়া। নিম্ন শ্রেণীর মানুষরাই মূলত এই লাইনের পাশে বাঁধে জীবন যাপনের টুকরো ছাউনি। এখানে নারী-পুরুষ নির্বিবাদে মাদক সেবন চলে। কেউ হাতের শিরা-উপশিরা গাঁথে সিরিঞ্জ খোঁচায়, কেউ বা আবার তোলে ধোয়া কু-লী, আর কেউ কেউ এক নাক বন্ধ করে অন্য নাকে টানে নরকের ঘ্রাণ...। জমাট বাঁধা শীত এদিকটায়। পুরো এলাকা-ঘুমে অঘোর। হয়তো দু’একজন সোয়েটার-জ্যাকেট পরিহিত গন্তব্য পানে ছুটছে। কী ভাবেন অত? কেন! এমনই... আচ্ছা এত ঘন শীতে আপনি এভাবে উদ্দেশ্যহীন কোথায় যাচ্ছেন? এই পথ যেদিকে চলে যায়...। কিন্তু কেন! আপনাকে সেই গাবতলী বাজারে যখন দেখলাম তখন থেকেই প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো আমার নিউরনকে উত্তেজিত করছে। আপনি অবশ্যই একজন সুশিক্ষিতা মানুষ, ভাল-উচ্চ কোন পরিবারের সদস্য। আপনাকে অবশ্যই সম্মান করছি। তবুও এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। আমি আপনাকে অনুসরণ করছি কেবল, সেই কিন্তুটা জানার লক্ষ্যে। আপনার মনে কি কোন দুঃখ, কিংবা পারিবারিক ঝামেলা বা অর্থনৈতিক সমস্যা...। - কেন! বললেই কি আপনি তার সমাধান করতে পারবেন? কুয়াশাভেজা বাতাস কাঁপিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠে মেয়েটি। আপনি পারবেন না সেকেন্ড পূর্বে-ঘটে যাওয়া অতীতকে বর্তমান করতে। কেউ পারে না কেউ। কেউ না... ভুল করে শোধ করা কখনও কখনও অসম্ভব। মেয়েটা বিড় বিড় করতে থাকে। একটা সময় চুপ হয়ে যায়। দূরে কোন রাত ভাঙ্গা পাখি ডানা ঝাপটে উঠে। কোন এক ঝুম বৃষ্টির দিনে তাদের বিয়ে হয়েছিল। স্থানীয় এক পরিচিত মিষ্টির দোকানে। আত্মীয় স্বজনের সমাগম, সানাই, উৎসব, খুশির, হইচই, সুগন্ধ খাবার- সব অনুপস্থিত ছিল। তিনজন বন্ধুর উপস্থিতি আর কাজী সাহেব ব্যাস্। রেজিস্টার খাতায় সই করতে গিয়ে হাত কাঁপছিল শাজমীর। বাবা-মার অগোচরে ভোর অন্ধকারে ছোট একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আরসাদের এক কক্ষ ঘরে আশ্রিত হয়েছিল সে। সপ্তাহ খানেক পরেই লঞ্চে উঠে ওরা পাড়ি জমায় আরসাদদের গ্রামে। বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হতে। আরসাদ মা মরা, বাবার আদর বঞ্চিত, সৎ মায়ের কঠিন সংসারে পিষ্ট অসামাজিক ছেলে। সে বহু বছর আগেই পরিবার বিচ্ছিন্ন করেছে নিজেকে। তাই তার কোন পিছুটান ছিল না। আর শাজমীও জোর করে চোখ-ফিরিয়ে রেখেছিল নিজের পরিবার থেকে। মাকে কতবার বোঝাল... মা তবুও এক রোখা- ‘ছেলেটাকে পাগলের মতো দেখা যায়’। মা-বাবার সঙ্গে রোজ আনা বিতর্ক মন রেষারেষি খেলা, কথা না বলা-মুখ না দেখার নীরব প্রতিযোগিতা। সহ্য হলো না তার। তাই রাতের আঁধারেই পাড়ি জমিয়েছিল সুখ-ছত্রের সন্ধানে। পুঁ...। ভাবনাগুলো ছিন্নভিন্ন করে ছুটে যায় ট্রেন। ঘন কুয়াশা। তাই গতি ধীর ট্রেনটার। ওরা এখন মালিবাগ রেললাইনে। এখানে সূর্য জাগার আগেই জেগে উঠে মানুষগুলো। রেললাইনের ধারে বেশ অনেকটা পথ পর্যন্ত বাজার বসে। মাছ, মুরগি, গোশতের পসরা বসে বেশ জায়গাজুড়ে। পাশেই শাক, সবজি, চাল, ডাল, লবণ, তেলের দোকান। এই পথ ধরে যেতে যেতেই গুলবাগ বাজার। প্রায় সবকিছু অনেক সস্তায় পাওয়া যায় এই বাজারে। কেননা বড় বড় বাজারে যেমন সবজি, মাছ তিন/চার দিন পরেও অবিক্রীত থেকে যায় সেগুলোই পাইকারি হারে অর্ধেক দামে কিনে নেয় এরা। গলিত পচা অংশ ফেলে দিয়ে ঝুড়ি সাজিয়ে বসে। শেষ হয়ে যায় চোখের পলকে। কেননা গুলবাগ বাসিন্দারা বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। ওদের কাছে সাত টাকা কেজির মুলা আর পনেরো টাকা ভাগায় মাছ অনেক কিছু। গুলবাগ রেলাইনের পাড়ে ছোট ছোট ঘর। এলাকাটাতে শ্রমজীবী মানুষের বিস্তার। ভীষণ ধীরে হাঁটে বড় ছায়াটি। ডান পাশে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। ঝাপ ফেলা সারি বাঁধা ছোট ছোট মুদিদোকান, কয়েকটা হোটেল, আবার দোকান, কিছু দোতলা- নিচতলা বাসা...। যে মানুষটি এতক্ষণ রাত দাঁপিয়ে হাঁটছিল সে হঠাৎ কীসের খোঁজে...? অবাক হয় নীল। -কী খুঁজছেন? মিনিট থেমে আবার বলে, কিছু কি খুঁজছেন আপনি! এই পথটা যদিও আমার তেমন পরিচিত নয়, তবও যদি বলেন সাহায্য...। মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে নীলের চোখে চোখ রাখে। নীল অবাক হয়, কেননা মেয়েটা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন দূরের মেঘে তার চোখ। কাঁধ ছড়ানো আঁকাবাঁকা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মেয়েটাকে এখন হাজার বছরের পুরাতন পাথরের ভাস্কর্যের মতো মনে হচ্ছে। ওর ত্রিকোণ চিবুকে চিক্ চিক্ করছে এক ফোঁটা জল। হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নীল। কী ব্যাপার! কাঁদছে নাকি মেয়েটা! হয়তো... কিন্তু চোখ জোড়া তো ভেজা নয়! -হু ... একটা জানালা...। হঠাৎ যেন জ্ঞান ফিরে আসে মেয়েটার। একটা জানালা খুঁজছি আমি। বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে আবার। নীল ও হাঁটতে থাকে পাশাপাশি। ওর মনে অসংখ্য প্রশ্ন হামাগুড়ি দেয়। একটা বিষয় খুব ভাবিয়ে তোলে ওকে- মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে! শাজমী তুহিনের চাচাতো বোন। প্রায়ই বেড়াতে আসত তুহিনদের বাসায়। ঠিক সন্ধ্যার পর সে সময়টাতে তুহিন অফিস থেকে ফিরে আসত তার পরই বাজাত কলিংবেল। শাজমী আসত আর হইচই করে ঘর একাকার করে ফেলত। হাঁড়ি-পাতিল ঠোকাঠুকি করে শুরু করে দিতো রান্না-বান্না। দুই ভাই- বোনের মধ্যে খুবই মিল ছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত, বিভিন্ন বিষয় তুলে শোরগোল করত। পল্লবী তুহিনের স্ত্রী; বছর তিনেক ওদের বিয়ে হয়েছে। সে কখনই ওদের কথার মাঝে পা বাড়াত না। সারা দিন অফিস শেষে সে নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়ত। শাজমীকে সে অপছন্দ করত ঠিক তা নয়, তবে তার এভাবে আসাটা তেমন একটা ভাল লাগত না। কেননা সারা দিন কর্মব্যস্ততার পর সিদুরে এই সময়টুকু তো তার আর তুহিনের একান্ত। শাজমী আর পল্লবী তেমন একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ আলাপচারিতা করত না। তারপরও মাঝে মাঝে- -শাজমী, তোমার স্বামী আর যোগাযোগ করে না? -না আপা, সে ভুলেই গেছে আমাকে.... খালার মুখে শুনেছি ও নাকি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে। কিন্তু , বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে ও তো...। -ধুর... আপা আপনি আমাকে হাসালেন। ওর কারও জন্যই মায়া মমতা নেই। -ও...। চুপ করে থাকে পল্লবী। আড়চোখে তাকায় শাজমীর দিকে। ভাবে, মেয়েটাকে তেমন আহত দেখাচ্ছে না। মুক্তির আনন্দে যেন সে মহাখুশি! কে... উ... কে.... উ.... রাতে গভীরে নিশাচর কুকুর। পাচ কি ছয়টা। ওদের পেছনে হাঁটছে কয়েকটা, পাশে পাশে হাঁটছে কয়েকটা। শীতের এই অবেলায় এতগুলো প্রাণীর হঠাৎ আবর্তন অনাকাক্সিক্ষত মনে হয় নীলের। কুকুরগুলোর চলার গতি তীক্ষè! ছেলেটা ভয় পেয়ে যায় মনে মনে। পাশ ঘেঁষে হাঁটতে থাকে মেয়েটার। সঙ্গের সঙ্গী খুবই সাবলীল। স্বাচ্ছন্দ্যে পথ চলছে। কেউ... কেউ...। বাম পামের কুকুরটা হাক দিয়ে উঠে। ভয় পেয়ে জাপটে ধরে মেয়েটার বাহু। কেপে উঠে বার কয়েক। -বোবা প্রাণী... কিছু করবে না। অভয় দেয় মেয়েটা। -না... না... বাবা, যদি কামড় দেয়। -শুনুন... এই কুয়াশাচ্ছন্ন ঘন আঁধারে ওরা যেমন আমাদের কাছে ভয়ঙ্কর কিংবা অপ্রয়োজনীয় ঠিক তেমনি আমরাও তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। এজন্যই এমন আচরণ করছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে আমরা ক্ষতিকর কিনা! -তবুও... কীভাবে পেছনে পেছনে তাড়াচ্ছে। আমার অনেক ভয় হচ্ছে। বলতে বলতে মেয়েটার আরও কাছ ঘেঁষে আসে। -উহু... কোন ভয় নেই। স্বাভাবিকভাবে হাঁটুন। চলে যাবে। কিন্তু নীলের ভয় মন থেকে যায় না। ওর মায়ের মুখ থেকে শোনা নানা ভাইয়ের ছোট বেলার গল্পটা মনে পড়ে। এমনই গভীর রাতে গঞ্জের চৌরাস্তার মোড়ে বেচারা অদ্ভুত কিছু কুকুরের পাল্লায় পড়েছিলেন। সেটা মাথায় আসতেই আরও ভয় পেয়ে যায় নীল। কাঁপতে, কাঁপতে বলে, যদি ভূত হয়...। মেয়েটা কোন উত্তর দেয় না। কুকুরগুলোর দিকে ঘুরে তাকায়। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুকুরগুলো সম্মোহিতের মত হয়ে পড়ে। মিনিট খানেক বাদে ওরা নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়। আর লেজ নাড়াতে থাকে। মেয়েটা ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করে। নীল সেই মাথা ঘোরাতে যায় অমনি মেয়েটা ধমকের সুরে বলে উঠে, আহ্ ... পেছনে ফিরে তাকাবেন না। সামনে দিকে হাঁটুন। জানেন না রাত্রির অন্ধকারে পথ চলতে পেছনে ফিরতে নেই? এই বিষয়টা নীলের ও জানা আছে। একটা অদ্ভুত কুসংস্কার। সে এইসব প্রমিত প্রথায় বিশ্বাস রাখে না। তবুও কী যেন ভেবে পেছনে তাকাল না আর। ওরা হাঁটতে থাকে। গুলবাগ ছাড়িয়ে রাস্তার পাড়ে একটা সিমেন্টের বেঞ্চি। ফেটে ফেটে গেছে এক পাশের সিমেন্ট। একটু চাপ খেলেই ঝুড় ঝুড় করে পড়ে। -ওফ্...বাপড়ে বাপ্ ... হয়রান লাগছে। এত হাঁটতে পারে মানুষ! বেঞ্চিটাকে দেখে ক্লান্তি অনুভূত হয় নীলের। হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। কী হল! বসেন না। বসেন বসেন। মেয়েটা বসে না। তাকিয়ে থাকে মেইন রোডের দিকে। এপাড়ে- মাঝখানে রেল-লাইন ওপাড়ে বড় রাস্তা। দিনের আলোতে ভিড় লেগে থাকে সেখানে। বাস-ট্রাক রিকসা-গাড়ি, সারা দিন হইচই। এখন অদ্ভুত শান্ত দেখাচ্ছে। সেখানে ধোয়া ধোয়া কুয়াশা। -তুহিন তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার। খুব জরুরী। -হু...বল। -শাজমী এভাবে কেন আসে? ওর এত ঘন ঘন আসাটা... তাছাড়া ইদানীং এখানে রাতেও থাকছে! -পল্লবী, ও আমার চাচাতো বোন। ছোটবেলা থেকেই আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। তাছাড়া ওর স্বামী ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। এ কারণে ও একটু আপসেট। মনের কথা শেয়ার করতে...। -তুহিন বাস্। মনের কথা শেয়ার করতে অন্যের স্বামী বেছে নিতে হবে, না? আহা হা আমার হেল্পফুল হাসবেন্ডরে...। -পল্লবী, শান্ত হও। একটু বোঝার চেষ্টা কর। তুমি আমার বউ আর শাজমী বোন। ওর প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব বোধ আছে। পল্লবী, কথা শোন, শাজমীর স্বামী সেপারেশন পেপার পাঠিয়েছে। মেয়েটার কোন কাজ নেই, নিজের নামে কোন সঞ্চয়পত্র নেই, বাচ্চাটার কোন ইন্স্যুরেন্স নেই... এমন অবস্থায় ওকে ছেড়ে যদি আমরা...। -আমরা নই। তুমি- তুমি ওকে ছেড়ে যেতে পারছ না। কিন্তু আমার পক্ষে এই ঝঞ্চাট পছন্দ করা সম্ভব নয়। তুহিন, আমি সব ছেড়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। একটু সুখ, একটু শান্তির আশায়, সেটা তোমার বোঝা উচিত। আমি বাচ্চা খুকি নই যে যা বলবে তাই মেনে নেব। -পল্লবী, তুমিও মেয়ে আর শাজমীও...। বেচারী বিপদে পড়ে...। -বাস্... তুহিন, এবার থাম। তুমি থাকো তোমার গোবেচারীকে নিয়ে। আমি চললাম। পাশের ঘর থেকে সবই শুনতে পায় শাজমী। বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে উঠছে। ঘুমের ঘোরেই। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শাজমী মাথা নত করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পল্লবীর হাত ধরে বলে, ভাবি-শোন...। পল্লবী ঝাটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় হাতটা। তুমুল কথা কাটাকাটি হয় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে। পল্লবী-অভিমানে ফেটে পড়ে। হঠাৎ প্রচ- রাগ সামলাতে না পেরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তুহিন সচল হয়ে উঠার আগেই জ্বলে উঠে আগুনের লকলকে শিখা... দাউ...দাউ। ভাই, আপনারা কোত্থেকে! এখানে এত রাতে...! সবুজ সোয়েটার। গলায় কাল একটা মাফলার আদ্যপ্রান্ত প্যাঁচানো। ভারি কানটুপি, বাদামি প্যান্ট আর বুট পায়। হাতে একটা লাঠিও আছে। তৃতীয় ব্যক্তির হঠাৎ আগমনে চমকে উঠে মেয়েটা। চোখ ফেরায় বড় রাস্তাটা থেকে। -নারে ভাই... এখানেই থাকি। শীতের কুশায়াকে এমনিতেই একটু হাঁটছিলাম। অদ্ভুত উত্তরে একটু হেসে নিল গার্ড। ভাই, এই কন্কনে শীতে মানুষ পারলে লেপ, তোষক, বেডিং এর নিচে ঢুইকা পড়ে। আর আপনারা ঘর থেকে বাইর হইয়া পড়ছেন...! -হ্যারে ভাই...। -তা বাসা কুন জায়গায় বলতেছিলেন? লোকটা পকেট থেকে ছোট-একটা কোটা খুলে তর্জনিতে কালো কিছু জিনিস নিয়ে দুই পাশে দাঁতের গোড়ায় পোরে। -আরও ঐ তো এই গলি দিয়া সোজা গেলে কাল রঙের গেটটা। তিনতলা বাসা। শূন্যে ছড়ি ঘুরায় নীল। -অ... গার্ড বুঝে নেয় ওরা স্থানীয়। ঠিক আছে ভাই। তাড়াতাড়ি বাসায় চইল্যা যাইয়েন। বিপদের হাত-পাও নাইক্যা। বলতে বলতে উল্টো রাস্তায় চলে যায় মানুষটা। মেয়েটা বেঞ্চিতে নীলের পাশে এসে বসে। নীল তাকিয়ে থাকে। পথ-সঙ্গী আনমনা। চোখ সামনের কুয়াশা মেশানো অন্ধকারে। মেয়েটা অন্যরকম। ওর মুখশ্রী খুব সরল কিন্তু কঠিন। চোখ জোড়া মায়াময় কিন্তু শীতল। চলার ভঙ্গিমা, কথা বলার ভঙ্গিমা সবকিছুতে লাবণ্য আছে কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগে। নীল তাকিয়েই থাকে। ডুবে যায়। ওর চেহারায় কোথায় যেন একটা দুঃখ আঁকা আছে- ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মন কু-লীতে- মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে। খুব সম্প্রতি। মনে করতে পারে না। জানেন এই যে এতটা পথ...। হঠাৎ মেয়েটা কথা বলে উঠে। এই পথ ধরে একবার আমি আর আমার স্বামী হেঁটেছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে...। বলে থেমে যায়। তাকিয়ে থাকে সামনের রেললাইনে। এই লাইনটা গুলবাগ ছাড়িয়ে ব্যস্ত খিলগাঁও এর উপর দিয়ে দিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে মিশে গেছে, চলে গেছে আরও বহুদূরে। গভীর রাত। হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে চাঁদটা। আর ঘণ্টা কয়েক পরেই পূর্ব দিকে আলো ফুটে উঠবে। লেপ মোড়ানো শীতার্ত নগরী ছুটতে শুরু করবে আবার। নীল আগ্রহ নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব শুনতে ইচ্ছে করছে ওর- -এই পথে হেঁটে হেঁটে কোথায় গিয়েছিলেন? -আগস্ট মাস। আমার জন্মদিন। আমরা সাভারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর আয়ত্তাধীন ছিল সবকিছু। ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সরকারের বিপক্ষে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করছিল। তাই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার হঠাৎ কারফিউ ঘোষণা করে। সন্ধ্যার ফ্যাকাশে আকাশ। যে যেভাবে পারছিল ঘরে ছুটছিল। আমরা সাভার সদর থেকে গাবতলী পর্যন্ত বাস পেয়েছিলাম। পরে আর পাইনি। না বাস, না ট্যাক্সি, না কোন যানবাহন। অগত্যা পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হয়েছিলাম। ঘন রাতে। দেশের অবস্থা প্রতিকূলে। তাই হাঁটতে হাঁটতে এই গুলবাগ পৌঁছেই ওর এক বন্ধুর বাসায় রাতটা পার করি আমরা। সে দিনটা খুব স্মরণীয় ছিল আমার কাছে। বলতে বলতে আবার থেমে যায় মেয়েটা। নীল ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে থাকে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। উচ্চারণে মাধুর্য আছে। নীলের চোখে ভাসতে থাকে রজনী কোলে মানব-মানবীর আঁধার পাড়ি। -আজ আপনি একা কেন! আপনার স্বামী কোথায়? -ও নেই। অনেক আগেই নিজস্ব গতি পাল্টে নিয়েছে। -মানে.... ঠিক...। অন্য কাউকে ভাল লেগে গিয়েছিল তার। জীবনের স্বাদ বদলাতে ভুলে গেছে অতীত। আমিও আর বাধা দেইনি। আত্মীয় স্বজন-প্রতিবেশীরা ভেবেছে আমার দোষ। আমি কাউকে কিছু বলিনি। তাতে কি কোন লাভ আছে? যে বোঝে না তাকে বোঝানো যায়, কিন্তু যে বুঝতে চায় না তাকে? একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, লুটিয়ে পড়ে অন্ধকারে। জানি না, সেপারেশন পেপারটা বোধহয় এখনও বালিশের নিচেই আছে। -কিন্তু ডিভোর্স-ই তো সমাধান নয়। আপনি তো ইচ্ছে করলেই...। নীলকে থামিয়ে দেয় মেয়েটা। হয়তো করতে পারতাম কিছু একটা। কিন্তু আমার ভাগ্যই যেখানে প্রতিকূলে...। নীল বুঝতে পারে মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। ট্রেন আসতে থাকে নিঝুম অন্ধকার কেটে কেটে। মেয়েটা হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় চলন্ত ট্রেনের পথে। ঘাড় ঘুরিয়ে নীলের দিকে তাকায়। ট্রেনের প্রচ- আলোয় চোখ বন্ধ করে ফেলে নীল। ওর মনে পড়ে মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে। সকালে পত্রিকার পাতায়। পেছনের পৃষ্ঠায় এক কলামের সংবাদের ইনসেট ফটোতে। শাজমীর আরা পারভীন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে গত রাতে। পুঁ...। হাক দিতে দিতে চলে যায় ট্রেনটা। নীল রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুঁজতে থাকে এতটা সময় পাশে থাকা সঙ্গীকে। চারপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা...
×