ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়লে ব্যাংক আমানত কমে না

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৯ আগস্ট ২০১৬

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়লে ব্যাংক আমানত কমে না

সরকারের বিপদ চারদিকে। ঋণ করলে বলা হয় সরকার ঋণ করে ঘি খাচ্ছে। আবার ঋণ যদি ব্যাংক থেকে করে, তাহলে বলা হয় সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে আমরা ঋণ পাচ্ছি না- বলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। এদিকে সরকার যদি সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে, জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ করে তাহলে ব্যাংকাররা ক্ষেপে লাল হন। তারা বলেন, সঞ্চয়পত্র মারফত ঋণ গ্রহণের ফলে ব্যাংকের আমানত কমছে। কারণ, বেশি সুদের লোভে মানুষ আমানত ভেঙ্গে সঞ্চয়পত্র কেনে। এভাবে দেখলে বোঝা যায় সরকার সমালোচনার শিকার সবদিক থেকেই। আবার সরকার যদি ঋণ না করে তার চাহিদা ‘ট্যাক্সের’ মাধ্যমে পূরণ করতে চায়, তাহলে তো চারদিক থেকে হৈচৈ পড়ে যায়। কারণ আর যাই হোক, কেউ কর দিতে চায় না। সবাই চায় সব ফ্রি হোক, সরকারের সব সেবা বিনামূল্যে দেয়া হোক। সর্বমুখী চাপের মধ্যেই সরকারকে মধ্যপন্থা বেছে নিতে হয়। কিন্তু এরপরও কেউ সরকারের প্রশংসা করে না। এই যেমন এবার এখন পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে কোন ঋণ গ্রহণ করেনি বলে খবর ছাপা হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠে। এতে বলা হয়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমছে। আপাতত তা ভাল খবর। এই মুহূর্তে সরকারের ঋণের বড় রকমের প্রয়োজন হয়নি। বড় বড় প্রকল্পের কাজে গতি আসলেই হয়ত ঋণের প্রয়োজন হবে। এর জন্য অর্থবছরের শুরুতেই বাজেট করা থাকে। কত টাকার ঋণ ব্যাংক থেকে করা হবে, কত টাকার ঋণ সঞ্চয়পত্র থেকে হবে, কত টাকার ঋণ বিদেশ থেকে গৃহীত হবে। এসব বাজেট অনেক সময় বাস্তবতার আলোকে রদবদল হয়। এতে দোষণীয় কিছু নেই। এবার যেমন সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে ব্যবসায়ীদের কোন আপত্তি থাকার কারণ নেই। ব্যাংকে ব্যাংকে এত টাকা পড়ে আছে যে সরকার নিলে তা আনন্দের বিষয় ব্যাংকের কাছে। সরকার ঋণের ওপর সুদ কম দেয়। তবু আনন্দ, কারণ সরকারী ঋণ শ্রেণীবিন্যাসিত (ক্লাসিফাইড) হয় না। কখনও খেলাপী হয় না। সরকারী ঋণ যেহেতু খেলাপী হয় না, কাজেই এর বিপরীতে ‘সংরক্ষিত তহবিল’ (প্রভিশন) রাখতে হয় না। এ বিষয়টি ব্যাংকাররা ভাবেন। ব্যবসায়ীরা ভাবতে চান না। এই মুহূর্তে যে বিষয়টি আবার আলোচনায় আসছে তা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র, তার বিক্রি তার ওপর পরিশোধিত সুদ ইত্যাদি। ব্যাংকাররা অভিযোগ করেন যে, সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে ফেলছে। তুলে সঞ্চয়পত্র কিনছে। আবার ‘প-িত’ অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেন যে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হারকে হতে হয় অন্যান্য সুুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা না হলে সুদের হারের নৈরাজ্য অর্থনীতিতে ক্ষতি ডেকে আনে। সঞ্চয়পত্র ইদানীং বেশি হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকার। এর আগের অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ২৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তো যৎসামান্য। সেই বছর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকার। ব্যাংকারদের কথা সত্যি হলে এই সময়টাতে ব্যাংকের আমানত কমার কথা। কারণ বেশি সুদের কারণে মানুষ আমানত তুলে সঞ্চয়পত্র কিনেছে। অথচ তথ্যে দেখা যাচ্ছে আমানত প্রতিবছর বাড়ছে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তলবী ও মেয়াদী আমানত ছিল সর্বমোট ৫ লাখ ৪০ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ব্যাংকিং খাতে সর্বমোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের। ২০১৬ সালের জুন মাসের তথ্যটি হাতের কাছে নেই। আমি নিশ্চিত এখন আমানত আরও বেড়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসেই ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে আমানত হ্রাসের কোন কারণ নেই। বিষয়টি খুবই সহজ। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির টাকা কোথায় রাখে? গুদামে? নিশ্চয়ই নয়। সরকার সেই টাকা শেষপর্যন্ত খরচ করে যা বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান পায়। এরা অবশেষে ব্যাংকেই এনে তা জমা দেয়। আমানতের আকার পরিবর্তন হয় মাত্র। আমানত কমে না। অতএব, ব্যাংকারদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। দ্বিতীয়ত, কোন ব্যক্তিই তার সব সঞ্চয় ব্যাংকে রাখবে না, এক ব্যাংকেও রাখবে না। সে সঞ্চয়পত্র কিনবে, সুবিধা পেলে শেয়ার কিনবে। হয়ত সোনা-দানাও কিনবে, কেউ কেউ জমি-দালান-ফ্ল্যাট কিনবে। কিন্তু ঐসব লেনদেনের শেষ পরিণতি ‘ব্যাংক-আমানত’। যার কাছেই টাকা সে নগদে পারতপক্ষে রাখবে না, আর সঞ্চয়পত্র মানুষ অফুরন্ত কিনতে পারে না। প্রতিটি সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ক্রয়ের উর্ধতম সীমা দেয়া আছে। যদি ধরা যায় মানুষ সমস্ত ব্যাংকের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনবে, তাহলে প্রথমে আমানত বেসরকারী খাতের না হয়ে সব সরকারী খাতের হবে প্রথম এবং পরে সরকারের খরচের পর তা হবে বেসরকারী খাতের। এখন প্রশ্ন সুদের হার নিয়ে ইদানীং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ব্যাংক আমানতের চেয়ে একটু বেশি। এটা কিন্তু ৩-৪ বছর আগে সত্য ছিল না। তখন ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার ছিল সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি। তখন কোন প-িত বলেননি যে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানো হোক। আসলে ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্র- এই দুটো দুই জিনিস। সঞ্চয়পত্র একবার কিনলে তা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে নগদায়ন করা যায় না। করলে ‘দ-ি’ দিতে হয়। এসবের মেয়াদ ৩ ও ৫ বছর- দীর্ঘমেয়াদী (লং ম্যাচুরিটি প্রডাক্ট)। ব্যাংক আমানত আজকাল সব তিনমাসী। নগদায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই ‘লিক্যুইড’ সম্পদ। যখন তখন নগদায়ন করা যায়। মেয়াদের আগে ভাঙলেও সঞ্চয়ী আমানতের হারে সুদ পাওয়া যায়। আরও বড় বিষয় হচ্ছে সঞ্চয়পত্র মানুষের সঞ্চয় বাড়ানোর একটা বিশেষ মাধ্যম। এর দ্বারা দেশবাসীকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এটা বিশ্বব্যাংক বুঝবে না। তাদের ‘জমিদার’ আমেরিকা এবং তার নাগরিকরা ঋণী, সবাই ঋণী। তাদের কোন সঞ্চয় নেই। সঞ্চয়ের দরকারও নেই। নাগরিকদের সকল চাহিদা রাষ্ট্র পূরণ করে। সোনার বাংলার সরকার তা করে না। বাঙালীকে তার সঞ্চয় রাখতে হয়। দুর্দিনে তাকে কেউ সাহায্য করে না। চাকরি গেলে কেউ তাকে ভাতা দেয় না। হাসপাতালে গেলে কেউ তাকে খরচ দেয় না। উপোস করলে কেউ এগিয়ে আসে না। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ তাকেই বহন করতে হয়। এমতাবস্থায় বাঙালীর জীবন আর বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ কর্মকর্তাদের জীবন এক নয়। বাঙালীকে সঞ্চয় করতে হয়। সেই সঞ্চয়ে সরকার প্রণোদনা যোগায়। সরকার যেহেতু নাগরিকের সকল চাহিদা পূরণ করে না, তাই সে নাগরিকদের সঞ্চয়ে উৎসাহ দেয়। এটা সরকারের সামাজিক দায়িত্ব। এটা কোন এ্যাকাউন্টিং নয়, এ্যাকাউন্টের কাজও নয় যে, বাজার বুঝে সুদের হিসাব করা হবে। এরই প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কিছুটা বেশি হতে পারে, যেমন এখন হচ্ছে। এতে দোষণীয় কিছু নয়। এবং সঞ্চয়পত্র কিছুটা বেশি বিক্রি হলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নানা রকম কুযুক্তি দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর সুযোগও নেই। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের চাকরিজীবীরা, দেশীয় বশংবদরা একথাটি মনে রেখে কথা বললে দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল। আমি বরং সরকারের কাছে প্রস্তাব করব ভিন্ন জিনিস। সরকার প্রতি বছর বাজেট করে। তখনই মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, বেওয়া-বিধবা, অবসরভোগী ইত্যাদি অসংগঠিত মানুষ ও নিরীহ মানুষের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা দরকার। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রে। সঞ্চয়পত্রের ওপর বিশেষ ভর্তুকি রাখা দরকার। এই শ্রেণীর লোক মানুষের কাছে হাত পাততে পারে না। বর্তমান বাজারে তার আয় অর্ধেক হয়েছে। ব্যাংকে সুদের হার খুবই কম। অথচ বাজার চড়াই থাকছে। শাক-সবজি, মাছ-মাংস দুধ কোনটার দামেই কমতি নেই- মূল্যস্ফীতির হার যাই বলা হোক না কেন। গড়ের হিসাবে কিছুই বোঝা যায় না। প্রতিবছর মানুষের আয় কত বাড়ছে সেই তথ্যও দরকার। তাহলে তুলনা করা যায় সত্যি সত্যি অবস্থা কী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষকের বেতন ১৯৭২ সালে ছিল ৫৫০ টাকা। এখন কত? হয়েছে অনেকগুণ। কিন্তু তার খরচ কত বৃদ্ধি পেয়েছে সেই হিসাবও করতে হবে। অতএব, সঞ্চয়পত্র নিয়ে হৈ চৈ করার কিছু নেই। সরকারের ঋণ নিয়েও হৈ চৈ এর কিছু নেই। অবশ্য দেখতে হবে সরকার ঋণের টাকায় ঘি খাচ্ছে কী-না। যদি ঋণের টাকা উন্নয়নে লাগে তাহলে সরকারের ব্যাংক ঋণই বা কিভাবে দোষণীয় হবে! লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×