ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী

সমাজ সংস্কারক ও কর্মবীর উইলিয়াম কেরি

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৯ আগস্ট ২০১৬

সমাজ সংস্কারক ও কর্মবীর উইলিয়াম কেরি

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে যে সকল বিদেশী এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষকে ভালবেসে তাঁদের ত্যাগ ও পরিশ্রম দিয়ে উন্নত জীবনের পথে এগিয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তাঁদের মধ্যে ড. উইলিয়াম কেরির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুগে যুগে সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকারের মধ্য থেকে যে সকল কর্মবীর মানুষকে আলোর পথে চলতে সাহায্য করেছেন তাঁদের মধ্যে ইংল্যান্ডের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম কেরিকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট কেরি ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটন শায়ারের পলার্সপিউরি নামক এক গ্রামের চার্চের পাদ্রী এডমান্ড ও তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ কেরির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৯৩-এর ১৩ জুন স্বদেশ ত্যাগ করে তিনি সপরিবারে ঐ বছর ১১ নবেম্বর কলকাতায় পৌঁছান। যিশু খ্রিস্টের শিক্ষা ও আদর্শকে প্রচার করতে আসবেন বলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ তাঁকে তাদের জাহাজে আসতে দেয়নি, পাছে তিনি হন যদি কোম্পানির স্বার্থের বিরুদ্ধে এক ‘ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট’! বাধ্য হয়ে কেরি ভারতে এলেন ডেনমার্কের জাহাজে চড়ে। কেরির শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। শৈশবেই তাঁকে জীবিকা অর্জনের জন্য জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হয়। সে বয়স থেকেই তাঁর ছিল এক অত্যন্ত উন্নত জীবনবোধ। কেরির বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। যেদিন তিনি জানলেন ইংল্যান্ডের মানুষ যে চিনি ব্যবহার করে তা আসে আমেরিকা থেকে। আর যে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসেরা তা উৎপাদন করত সেই দাসদের উপরে করা হতো অনেক নির্যাতন। সেদিন থেকেই তিনি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ চিনি খাওয়া বন্ধ করে দেন। কোমল হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেনা-অচেনা মানুষের জন্য জুতা সেলাই করতে করতে কিশোর কেরি পেলেন আর্তমানবতার সেবার মহান শিক্ষা। কেরি জুতা সেলাই করতে করতে মনস্থির করেছিলেন পাপের কালিমা থেকে মুক্তিদাতা যিশু খ্রিস্টের বাণী প্রচারে তাঁর জীবন উৎসর্গ করার জন্য। তাই কেরি ভারতে এসেছিলেন মূলত একজন মিশনারী হয়ে। এ কথা বলা প্রয়োজন, ধর্ম তাঁর কাছে কেবল একটা তত্ত্ব ও আচারসর্বস্ব কোন বিষয় ছিল না, তা ছিল এক সম্পূর্ণ নতুন জীবনবোধ, সমস্ত জগত ও জীবনকে অকৃত্রিম ভালবাসায় আপন করার দীক্ষা। সম্পূর্ণ নির্মোহ আত্মত্যাগের আদর্শে তা প্রচার করতে এসে আমৃত্যু তিনি এই উপমহাদেশে কাটিয়েছেন শত রকমের সমাজ সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে। ১৮৩৪-এর ৯ জুন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্থির লক্ষ্য নিয়ে, শত বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রতিটি কাজে তিনি এগিয়ে গেছেন। কর্মবীর কেরি অবিভক্ত বাংলায় ৪১ বছর একনাগারে কাজ করেছেন, করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। তার মধ্যে কোনদিনও ইংল্যান্ডে তাঁর স্বজনদের কাছে ফিরে যাবার সময় ও সুযোগ হয়নি। এদেশ ও সাধারণ মানুষকে তিনি এতই ভাল বেসেছিলেন যে, তিনি একবার বলেছিলেন, “গু যবধৎঃ রং বিফফবফ ঃড় ওহফরধ, ধহফ ঃযড়ঁময ও ধস ড়ভ ষরঃঃষব ঁংব, ও ভববষ ঢ়ষবধংঁৎব রহ ফড়রহম ঃযব ষরঃঃষব ও পধহ”. নিজের বিষয়ে তাঁর আরও মন্তব্য ছিল, ও ধস ধ ঢ়ষড়ফফবৎ,- ‘আমি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছি।’ বহু যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধর্মীয় কুসংষ্কার ও গোঁড়ামির অন্তহীন বাধার মধ্য দিয়ে কাজ করেছেন। এমন এক সময়ে তিনি এদেশে এসেছিলেন যখন শিল্প বিপ্লবের ঢেউ ইউরোপের সর্বত্র নাড়া দিয়েছিল। ইউরোপের নাবিকেরা ইতোমধ্যে পেয়েছিল নানান দেশের সন্ধান। ফ্রান্সে সম্রাট ও জমিদারদের শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে সাধারণ মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের সেøাগানে হয়েছিল মুখর। আমেরিকাও হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ইউরোপের চার্চে এসেছিল এক নতুন জাগরণ, মধ্যযুগের অনেক গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে সংস্কারকগণ করেছিলেন চার্চকে মুক্ত। আমাদের কাছে কেরি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর প্রগতিবাদী চিন্তা-চেতনা ও সংস্কারকর্মের জন্য, যার মূল প্রেরণা ছিল মানুষের সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য খ্রিস্টের জীবনমুখী শিক্ষা। তিনি ছিলেন একজন কর্মযোগী মানবপ্রেমিক। ধর্মের সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যার গ-ি পেরিয়ে তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মতৎপরতা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কৃষিকর্ম, উদ্যানবিদ্যা, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থায়ী স্বাক্ষর রেখেছে। ১৭৬৫ সালে ভারতবর্ষে শুরু হওয়া দ্বৈত-শাসনের কুফলে ১৭৭০ বাংলায় আসে এক দুর্ভিক্ষ। সেটার আঘাত মানুষ ভুলতে না ভুলতেই লর্ড কর্নওয়ালিস্ জারি করে দিলেন কুখ্যাত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’, যার ফলে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ বণিক ও দেশীয় জমিদাররা সাধারণ মানুষকে শোষণ করার সুযোগ গ্রহণ করতে থাকে। একজন মিশনারীরূপে খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা প্রচার করতে করতে বাংলার সাধারণ দরিদ্র ও শোষিত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য অনেক কাজ তিনি সাধন করেছেন। নিম্নবর্ণের দুর্বল মানুষের ওপরে উচ্চবর্ণের মানুষের অবহেলা ও অত্যাচারের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভারে তারা যেন পরিণত হয়েছিল ক্রীতদাসে। ১৭৯২ সালে প্রচলিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফলে তাদের ওপরে জমিদারদের অত্যাচার যায় বেড়ে। ঐ সব দরিদ্র চাষীকে আর্থিক সাহায্যের লক্ষ্যে ১৮২০ সালে কেরি শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সঞ্চয় ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক। মহাজনী ঋণের বোঝার হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় সেদিন পায় অনেক দরিদ্র কৃষক। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা সমন্বিত ব্যাংক যদিও ভারতবর্ষে তার অনেক আগে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল তথাপি সমাজে মহাজনী ঋণের অভিশাপ তার দ্বারা খর্ব হয়নি। একদিকে ধর্ম ও সামাজিকতার অপব্যাখ্যাজনিত অনেক কুসংস্কার, অন্যদিকে সেই অর্থনৈতিক শোষণ। ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানির ক্ষমতা ও অর্থলোভের জন্যই এদেশের কিছু মোসাহেব স্বার্থপর মানুষই সাধারণ মানুষের দুঃখভোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের কায়েমী স্বার্থরক্ষার জন্য সমাজের গোঁড়াপন্থী নেতারা চায়নি কুসংস্কারের অন্ধকার ভেদ করে সাধারণ মানুষ আলোর পথে পা দিক। কোম্পানি তার নিজ স্বার্থে ঐ সমস্ত লোককে ক্ষেপাতে চায়নি। সব কিছু মিলে সাধারণ মানুষের জীবন হয় বোঝার মতো। বানফোঁড়া, গঙ্গায় শিশু বিসর্জন, রথের চাকার নিচে ফেলে শিশুহত্যা, চরকপূজা, অন্তর্জলি, অস্পৃশ্যতা, কন্যাশিশু হত্যা, শিশু বিবাহ, কুষ্ঠরোগীকে পুড়িয়ে মারার মতো অনেক কুসংস্কার জগদ্দলের মতো মানুষের জীবনের ওপর চেপে বসেছিল। এমনি দুর্বিষহ অবস্থা কেরির মনকে সব সময় কাঁদিয়েছে। কেরি মানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন ঈশ্বরকে ও মানুষের জন্য মহৎ কাজকে। কেরির মতো মানুষ সকল মহলেই বিভিন্ন কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ঐ সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কেরি তাঁর সহযোগী মিশনারীগণ, দেশী ও বিদেশী অনেক মানবতাবাদী এবং সমাজ সংস্কারক যেমন : রাজা রামমোহন রায়, উডনি, বুখানন, ফাউন্টেন, হলওয়েল, স্টাভার্নিয়ে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে আন্দোলন করেন। ফলে ধীরে ধীরে ঐ সমস্ত কুপ্রথার প্রভাব থেকে সমাজ মুক্ত হতে থাকে। ১৮২৯ সালে গবর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সরকারী অধ্যাদেশ বলে সতীদাহ প্রথা বেআইনী ঘোষিত হয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরির অবদান চিরস্মরণীয়। বাংলা গদ্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৮০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি ছাপান বাংলায় প্রথম গদ্য বই ‘মথিয়ের রচিত মঙ্গল সমাচার’। ১৮০১ সালের আগস্ট মাসে ছাপান কথ্য বাংলায় রচিত প্রথম বই ‘কথোপকথন’। ১৮০২ সালে ইংরাজীতে ছাপানো হয় কাশীরাম দাসের মহাভারত। বাংলা সাহিত্যে কেরির সবচেয়ে বড় অবদান বলা যায় বাইবেলের বঙ্গানুবাদ। তিনিই প্রথম দিকে বাংলা ভাষাসহ আরও তিন-চারটি ভাষায় ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা করেন। তিনি ছিলেন উঁচু মাপের ভাষাবিদ ও অনুবাদক। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল বাংলা, মারাঠি ও সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে। বাইবেল অনুবাদ ছাড়াও কেরি ১৮১২ সালে রচনা করেছিলেন ‘ইতিহাসমালা’ নামক বই, যা পরে পরিণত হয় বাংলা সাহিত্য ও কৃষ্টির এক মূল্যবান গবেষণা পুস্তকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ঈধৎবু ধিং ঃযব ঢ়রড়হববৎ ড়ভ ঃযব ৎবারাধষ ড়ভ রহঃবৎবংঃ রহ ঃযব াবৎহধপঁষধৎং’. ভারতে কেরিই সর্বপ্রথম সংবাদপত্র ছাপান; তার নাম ‘সমাচার দর্পণ’। এদেশের ভাষা-সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষকে তিনি এতই ভাল বেসেছিলেন যে, তিনি এদেশের বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেনÑ ‘ও ংবব ড়হব ড়ভ ঃযব ভরহবংঃ পড়ঁহঃৎরবং রহ ঃযব ড়িৎষফ...’ বাংলা ভাষার বিষয়ে সেই যুগেই তাঁর কথা ছিল আরও চমৎকার, ‘ঙহব ড়ভ ঃযব সড়ংঃ বীঢ়ৎবংংরাব ধহফ বষবমধহঃ ষধহমঁধমবং ড়ভ ঃযব ঊধংঃ’. কেরি এদেশের মানুষ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সম্মান করেছেন। তিনি বলেছেনÑ ‘ভারতবাসীর যাহা নিজের ও নির্দোষ, তাহা পরিত্যাগ করা কোনমতেই কর্তব্য নহে। বরং বিদেশী মিশনারীদের উচিত যেন তাঁহারা সেই সকলের প্রতি সমুচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।’ শিক্ষা প্রসারের জন্য কেরি ও তাঁর সহকর্মী যশুয়া এবং হান্না মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, ফাউন্টেনের অবদান ছিল অসামান্য। ১৮০০ সালে তিনি দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য অনেক অবৈতনিক পাঠশালা স্থাপন করেন। ১ জুন, ১৮০০-এ বাঙালী ছেলেদের জন্য প্রথম স্কুল শুরু হয়। ভারতবর্ষে কেরিই প্রথম তৃণমূল পর্যায়ে আধুনিক অর্থে প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলন করেন। তাঁরই উৎসাহে হান্না মার্শম্যান বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের জন্যও অনেক অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেন। মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য হান্না মার্শম্যানের পরিচালনাধীন একটি ‘সোসাইটি’ও গঠন করা হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে মেয়েদের একটি স্কুল খোলা হয় এবং ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এরকম ৩১টি স্কুলে পাঁচ শতাধিক মেয়ে পড়ত। ১৮১৬ সালেই তাদের স্থাপিত ১০০ অবৈতনিক ও পাঠশালায় কমপক্ষে দশ হাজার হিন্দু-মুসলমান ছাত্র লেখাপড়া শিখত। কেরিই প্রথম ভারতে সাধারণ পর্যায়ে স্ত্রী শিক্ষার প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেরির সহকর্মীরা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক স্থানেই প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং ঐসব স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা। বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার জন্য কেরি সুদীর্ঘ ৪০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর কেবলমাত্র বাইবেলের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করেননি। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই তিনি তাঁর সামগ্রিক পরিচিতি ও জ্ঞান মানুষকে দান করেন। তিনি সত্যিই বুঝেছিলেন যে, বাইবেলের বাইরে অন্যান্য বিদ্যা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্যকলা ইত্যাদির চর্চা প্রয়োজন। ধর্মের নামে শত রকমের গোঁড়ামি, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে সেদিন কেরি অনুভব করেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের। কেরি ও তাঁর সহকর্মীরা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট স্থাপন করেন শ্রীরাম কলেজ, যা আজও সমগ্র এশিয়ায় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ঐ কলেজের ঘোষণাপত্রে কেরি বলেনÑ ‘এই কলেজের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সকল ছাত্রছাত্রীর মেধা ও মনের সীমাকে যতদূর সম্ভব সম্প্রসারণ করা এবং সেই লক্ষ্যে জ্ঞানÑবিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের এমনভাবে শিক্ষিত করে তোলা যাতে ভারতবর্ষের কল্যাণ হয়।’ ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডারিক কলেজের প্রথম গবর্নর ও ইংল্যান্ডের ভাইসরয় লর্ড হেস্টিংস হন প্রথম পৃষ্ঠপোষক। ভারতবর্ষ শ্রীরামপুর কলেজই সর্বপ্রথম রাজকীয় সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়। কালক্রমে এই বিদ্যাপীঠ ভারতীয় রেনেসাঁর ক্ষেত্রে কালজয়ী প্রভাব বিস্তার করে। ভারতে কেরির ৪১ বছরের মধ্যে দীনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুরেই ২১ বছর কাটান। কারণ তদানীন্তন ভারতের রাজধানী কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৈরিতার কারণে তিনি সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমি যেদিন ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ব্যাপ্টিস্ট কলেজের প্রাঙ্গণে সর্বপ্রথম প্রবেশ করি তখন দরজা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দুটি জিনিসের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তার একটি ছিল দরজার ডান পাশে অবস্থিত ক্লাসরুমের মধ্যে রাখা উইলিয়াম কেরির ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র ও ভারত থেকে তাঁর লেখা কিছু চিঠি। অন্যটি ছিল দরজার বাম পাশে সিঁড়ির ওপরে স্টেই›ড গ্লাসের চিত্র, যাতে দেখানো হয়েছে কিভাবে চার্চ কর্তৃপক্ষ উইলিয়াম টিন্ডেলকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। টিন্ডেলের ‘অপরাধ’ ছিল ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ যাতে তাদের মাতৃভাষায় বাইবেল পড়তে পারে তার জন্য ইংরেজীতে বাইবেল অনুবাদ করা। কারণ ঐ সময়ে চার্চে কেবল লাতিন বাইবেলই ছিল আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য। যুগে যুগে ধর্মের নামে পৃথিবীর সর্বত্রই অন্যায় কাজ সমাজে হয়েছে। আজও হচ্ছে। ধর্মের অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে পৃথিবীর অনেক স্থানে এখনও হতভাগ্য অনেক মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতির এ যুগে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম। তদানীন্তন বাংলা তথা ভারতবর্ষের অগণিত সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের দুঃখ ও ব্যথার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত উইলিয়াম কেরির মহাজীবন অনগ্রসর ও দুর্বল মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রেরণা। লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্ব মহাবিদ্যালয় বাংলাদেশ
×