ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বহু বছর পর সরব ‘বায়তুল আমান’

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৮ আগস্ট ২০১৬

বহু বছর পর সরব ‘বায়তুল আমান’

মোরসালিন মিজান, পাড়াতলী, নরসিংদী থেকে ঘুরে এসে ॥ শামসুর রাহমানের দুটি বিখ্যাত কবিতার জন্ম হয়েছিল তার পিতৃনিবাস পাড়াতলীতে। নরসিংদী জেলার এই গ্রামে তিনি লেখেন স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান। একই জায়গায় প্রায় একই সময়ে লেখেন- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা। কবি নেই। কবিতার পঙ্ক্তিগুলো যেন কানে বাজছিল। পুরনো পরিত্যক্তপ্রায় বাড়ি তুলে ধরছিল কবির সেসব দিনের স্মৃতি। অদূরেই পরিবারের জমিতে নির্মিত স্কুল ভবন। সেখানে হলো স্মৃতিচারণ। কবিতা হলো। স্থানীয়রা বললেন। ঢাকা থেকে এসেছিলেন কবিরা। কবি পরিবারের সদস্যরা এসেছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে পালন করা হলো শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। বহু বছর পর সরব হয় ‘বায়তুল আমান’। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে নির্মাণ করা একতলা পাকা বাড়িতে অনেক দিন কাটিয়েছেন কবি। সামনেই পুকুর ঘাট। কবির পৈত্রিক বাড়িটিতে এখন আর কেউ থাকেন না। ফলে বাড়ির চেহারা অনেকটাই পোড়াবাড়ির মতো। কবি মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের এপ্রিলে এখানে এসেছিলেন। ছিলেন মাসতিনেক। তখনই তিনি বাড়ির সামনের এই আমগাছের তলায় বসে একই দিনে ওই বিখ্যাত কবিতা দুটি লিখেছিলেন। তবে কবির কাছে পুকুরটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তার দ্বিতীয় ছেলে মতিন রাহমান কিশোর বয়সে এই পুকুরে ডুবে মারা যায়। বাড়ির পাশেই মতিনের কবর। সম্ভবত একই বেদনাদায়ক স্মৃতির কারণেই পৈত্রিক বাড়িতে কবি তেমন আসতেন না। ঢাকা থেকে যাওয়া কবিরা সেসব স্মৃতি ঘুরে দেখলেন। কবি পরিবারের সদস্যরাও দেখলেন নতুন করে। পুত্রবধূ টিয়া রাহমান জানান, ২০০৪ সালে কবি এখানে সর্বশেষ এসেছিলেন। তখন ছিল শীতকাল। সরষে ক্ষেতের পাশে বসে তিনি খুবই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। পরে সকলেই সমবেত হন পাড়াতলী কলিমউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এখানে কবির দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দিনভর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরিবারের উদ্যোগে গঠিত কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি ফাউন্ডেশন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে পাড়াতলী কবির বাড়ির পাশেই কলিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে সকালে ছিল কবির ভ্রাতুষ্পুত্র ও কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান তৌফিকুর রাহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও শিক্ষার্থীদের কবিতা আবৃত্তি। এতে স্থানীয় পাড়াতলী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনুল হক চৌধুরী কবির জীবন নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করেন। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জানান, কবির স্মৃতি ধরে রাখতেই এ ফাউন্ডেশন করা হয়েছে। এর আগে বুধবার সকালে বনানী কবরস্থানে কবি শামসুর রাহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ, গোলাম কুদ্দুছ, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। কবির পরিবারের পক্ষে তার ছেলে ফাইয়াজ রাহমান, পত্রবধূ টিয়া রাহমান দুই নাতনি দীপিতা রাহমান ও নয়না রাহমান এবং তার ভাগ্নেরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। সেখান থেকে কবির বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু হয়। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের ৭৭ বছরের বর্ণময় জীবনের বড় অংশজুড়েই নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগরজীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবিতার কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তার ভূমিকাটি একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত করেন সাহিত্যের ভুবন। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতায় ধাবিত হলেও একটা সময় দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন নিবিড় মমতায়। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তার দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একই সঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত। ১৯৪৯ সালে শামসুর রাহমান লেখেন প্রথম কবিতা ‘১৯৪৯’। প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আর এই শুরুটা ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতার সৃষ্টিসম্ভার। পত্রপত্রিকায় লেখা তার চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই এপার-বাংলার কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলোÑ রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ ও আমি অনাহারী। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয়া হয়। বাবা মুখলেসুর রাহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরান ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নেননি।
×