ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রহ্মপুত্র এখন মরা গাঙ

জয়নুলের শিল্পকর্মের উৎস, খুবলে খাচ্ছে আগ্রাসী চক্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৮ আগস্ট ২০১৬

জয়নুলের শিল্পকর্মের উৎস, খুবলে খাচ্ছে আগ্রাসী চক্র

বাবুল হোসেন ॥ একেবারে হারিয়ে না গেলেও এককালের উত্তাল ব্রহ্মপুত্র আজ যৌবনহারা, মরা খাল, শীর্ণ। এক সময় যে নদ প্রশস্ত ছিল অন্তত ১২ থেকে ১৪ কিমি, আজ সেই নদ ভরাট হতে হতে স্থান ভেদে কোথাও মাত্র এক শ’ থেকে দু’শ’ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে কমে গেছে এর নাব্য আর চঞ্চলতা। একদা যে নদের উত্তাল ঢেউ ছাপিয়ে যেত দুকূল। সে আজ উত্তালহীন থাকে ভরা বর্ষাতেও। তার সেই তর্জন-গর্জন এখন আর শোনা যায় না। ব্রহ্মপুত্রের বুকচিরে এখন আর চলে না কোন পালতোলা নৌকা কিংবা মালবোঝাই কোন জাহাজ থামে না কোন বন্দরে, ঘাটে। চরদখলের মতোই চলছে ব্রহ্মপুত্র জবরদখল। প্রায় পানিশূন্য ব্রহ্মপুত্রর যে পাশ জেগে উঠছে সেখানেই হামলে পড়ছে ভূমি আগ্রাসী চক্র। তাই সে আজ কেবলই এক মরা গাঙ, ময়মনসিংহের পুরনো নদ ব্রহ্মপুত্র। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই ব্রহ্মপুত্রের এমন দশা। প্রচার রয়েছে-১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রভাবে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা খাল যমুনা নদীতে রূপ নেয়। পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে পলি জমে জমে বর্তমান দশায় এসে পৌঁছে। অথচ বিশ শতকের গোড়ার দিকেও ব্রহ্মপুত্র ছিল বিশাল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনেক শিল্পকর্মের উৎস ছিল এই ব্রহ্মপুত্র। শিল্পাচার্যের শিল্পী জীবনের শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের এই ব্রহ্মপুত্র পার থেকেই। তাঁর চিত্রকলার ভিত্তিও ছিল ব্রহ্মপুত্র। শহরের পাশ দিয়ে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র নদ, নদের পানি, নদের মাঝি, চর, চরের মানুষ, চরের কাশফুল, জেলেদের নদীতে মাছ ধরা, জাল ফেলা, মাঝির গুনটানা-এসবের সঙ্গে চির পরিচিত ছিলেন জয়নুল। তাঁর শিল্পকর্মে তাই এসবের প্রতিফলন ঘটেছে নিখুঁতভাবে। তিরিশের দশকে রোমান্টিক চোখে দেখা শিল্পাচার্যের ব্রহ্মপুত্র ও তীরবাসী মানুষের জীবনচিত্র, চল্লিশের দুর্ভিক্ষের চিত্রশালা, মায়ের শীর্ণ স্তনে অপুষ্ট শিশুর পুষ্টি সন্ধানের ব্যর্থ চেষ্টা, সাঁওতাল জীবনের ছবি, লোকশিল্প ভিত্তিক কাজ, মেক্সিকোর পাহাড়ী প্রকৃতি মানুষের জীবনের স্কেচ, সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু জনযাত্রাসহ নানা দুর্লভ ছবি দিয়ে শিল্পাচার্য ব্রহ্মপুত্র পাড়ে গড়ে তোলেন জয়নুল সংগ্রহশালা। বিগত ১৯৭৫ সালের মধ্য এপ্রিলে বাংলা নববর্ষের দিনে এক উৎসবমুখর পরিবেশে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। ব্রহ্মপুত্র পারের নৈসর্গিক পরিবেশের এই সংগ্রহশালায় প্রতিদিন জয়নুলভক্ত শত শত অনুরাগী এস ভিড় জমান এখন। ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ ‘ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা’র আহমদ সাইফ রচিত ‘পানি সম্পদ’ থেকে জানা যায়, হিমালয়ের উত্থানের বহু পূর্বেও ব্রহ্মপুত্র এ উপমহাদেশে প্রবাহমান ছিল। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত। ডা. গ্রিফিত’র মতে, ব্রহ্মপুত্র আসাম পর্বতমালা মধ্যস্থিত ব্রহ্মকু- বা লৌহিত্য সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তিনি স্বচক্ষে ব্রহ্মকু- দেখে এসেছিলেন। আরেকটি মত হচ্ছে, তিব্বতের মালভূমিতে অবস্থিত মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমাইয়াংডুং হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি। প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াজেদ রচিত ‘বাংলাদেশের নদীমালা’ থেকে জানা যায়, তিব্বতের মানস সরোবরে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি। হিন্দুদের সৃষ্টি দেবতা ব্রহ্মার মানসপুত্র রূপে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্রের আগে নাম ছিল লৌহিত্য। মহাভারতেও ব্রহ্মপুত্রের নাম লৌহিত্য উল্লেখ আছে। লোহিত সরোবর থেকে নিঃসৃত বলেই এর নাম হয়েছে লৌহিত্য। এই লৌহিত্যের পরবর্তী নামই হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। এই নাম পরিবর্তনে আর্য ও প্রকৃতি পূজার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রহ্মপুত্র ছিল বিশালকায়। এজন্যই সে ‘নদ’ রূপে কীর্তিত হয়েছে। পুরাণে একটি কথা রয়েছে। তা হলো- প্রাচীনকালে জমদাগ্নি নামে এক মুনি ছিলেন। পরশুরাম নামে তার এক পুত্র ছিল। বাবার নির্দেশে পাষ- পরশু মা রেনুকা ও ভাইদের কুঠারাঘাতে হত্যা করেন। মাতৃহত্যার সেই পাপে কুঠারটি আটকে যায় পরশুরামের হাতে। এ সময় বাবা পরামর্শ দেন, যে স্থানের পানি সবচেয়ে পবিত্র সেখানে ¯œান করলেই কুঠার খসে পড়বে এবং মা-ভাই জীবন ফিরে পাবে। এই পাপ মোচনে পরশু বনে জঙ্গলে ধ্যান ও তপস্যায় মগ্ন হয়ে পড়েন। এক সময় তিনি ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পেরে তার খোঁজে বের হয়ে পড়েন। ব্রহ্মপুত্র তখন ছোট্ট একটি হ্রদের রূপ নিয়ে আত্মগোপন করছিল হিমালয় পর্বত গহ্বরে। পরশুরাম এর পাশে দাঁড়িয়ে স্তুতিপাঠ শেষে ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্রহ্মপুত্র হ্রদের জলে। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে কুঠারটি খসে পড়ে গিয়ে পাপ মোচন হয়ে যায়। পরশুরাম এরপর সর্বপাপহর এ পবিত্র জল মানুষের নাগালে পৌঁছে দেয়ার পণ করলেন। তিনি কুঠারকে পরিণত করেন লাঙলে। তারপর সেটি পর্বতে চালিত করলে সেই ফলক ধরে ব্রহ্মপুত্র নেমে আসে সমভূমিতে। এক পর্যায়ে সেই লাঙলটি আটকে যায় নারায়ণগঞ্জের কাছে লাঙলবন্দে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানটির নাম হয় লাঙলবন্দ। সেই থেকে প্রতিবছর চৈত্র মাসে অশোকাষ্টমী তিথিতে এই লাঙলবন্দে তীর্থ¯œান হয়। ব্রহ্মপুত্রের আক্রমণ আগ্রাসনের কারণে কত শত পরিবার যে নিঃস্ব হয়েছে, কত শত একর জমি ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে এর পেটে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। একটি উদাহরণ থেকে এর রুদ্র মূর্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৭ সালের ১ মে। এজন্য প্রয়োজন পড়ে জেলা সদর দফতর প্রতিষ্ঠার। আহমদ তৌফিক চৌধুরীর ‘শহর ময়মনসিংহের ইতিকথা’ থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলা সদর দফতর স্থাপন করা হয় বেগুনবাড়ির কোম্পানির কুঠিতে। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনে একরাতে কোম্পানির কুঠি বিলীন হয়ে গেলে পরে সেটি স্থাপন করা হয় খাকডহরে। কিন্তু এখানেও এটি বিলীন হয়ে গেলে পরে ১৭৯১ সালে সেহড়া মৌজায় জেলা সদর দফতার স্থানান্তর করা হয়। সর্বশেষ স্থাপন করা হয় বর্তমান অবস্থানে। অনেকে বর্তমান স্থানে জেলা সদর দফতর স্থাপনে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কেননা তখনও এই স্থানটি ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসন থেকে নিরাপদ ছিল না। ময়মনসিংহের তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর মি. রটনও বর্তমান স্থানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় স্থাপন করে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে যখন এই জেলা শহর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এক পত্রে ব্রহ্মপুত্রের হেয়ালিপনায় ময়মনসিংহের তৎকালীন কালেক্টর মি. বেয়ার্ড মন্তব্য করতে গিয়ে লেখেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের ন্যয় ভীষণ নদীর তীরে এ জেলার সদর দফতার স্থাপন আমি কোন মতেই সঙ্গত মনে করি না’। মি. বেয়ার্ডের এই আশঙ্কা সত্য না হলেও ব্রহ্মপুত্রের এই আগ্রাসন এখন আর নেই বললেই চলে।
×