ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৪ নারী জেএমবি পাঁচদিনের রিমান্ডে

ফেসবুকের ফাঁদে পা দিচ্ছে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৮ আগস্ট ২০১৬

ফেসবুকের ফাঁদে পা দিচ্ছে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হালে ফেসবুকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। ফেসবুকের সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা। সোমবার র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত নতুন জেএমবির চার নারী সদস্যের মধ্যে ডা. ঐশী তাদেরই একজন। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউকে একবার জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করতে পারলেই হলো, ব্যস! এরপর তা ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসের মতো। গ্রেফতারকৃত চার নারী জেএমবি সদস্যকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। মামলাটির তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মামলা তদন্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা রয়েছে। গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর রমনা থানাধীন মগবাজার থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশী, গাজীপুর থেকে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বেসরকারী মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসী বিভাগের ছাত্রী আকলিমা রহমান, মিরপুর পাইকপাড়া জনতা হাউজিং এলাকা থেকে মানারাতের একই বিভাগের ছাত্রী মৌ ও মেঘনাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। এ ব্যাপারে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়। বুধবার গ্রেফতারকৃতদের দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৪ এর উপ-অধিনায়ক মেজর সাঈদ হাসান জানান, মামলাটির তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা রয়েছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গী সংগঠনগুলো নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে। মোটামুটি সমমনা জঙ্গী সংগঠনগুলো অনেকটাই একত্রিত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই জঙ্গী তৎপরতা রয়েছে। তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কৌশল নিয়েছে তারা। গ্রেফতার এড়াতে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একেক প্রতিষ্ঠানে একেকটি করে জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে চলছে জঙ্গী কার্যক্রম। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ নেই, সেখানে ফেসবুকসহ প্রযুক্তির মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। এটি তাদের গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দু’ চারজন গ্রেফতার হলেও বাকিরা গ্রেফতারের বাইরেই থাকছে। আর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি অনুকূল পরিবেশ রয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। গ্রেফতারকৃত ডা. ঐশী প্রথম জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে ফরহাদ নামের একজনের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে। তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডা. ঐশী পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ফরহাদের মাধ্যমে ঐশী খেলাফত নিউজ, আনসার আল ইসলাম, আইএসআই ও একিউআইএসের নানা বিষয়ে জানতে শুরু করে। ঐশী পুরোপুরি জঙ্গী বনে যাওয়ার পর সংগঠনের কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরেই পরিচয় হয় মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেফতারকৃত আকলিমা রহমানের সঙ্গে। আকলিমার সূত্র ধরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফামার্সী বিভাগের গ্রেফতারকৃত দুই ছাত্রী মৌ ও মেঘনা। পরবর্তীতে সবার সঙ্গে সবার ঘনিষ্ঠতা হয়। তারা পবিত্র কোরান হাদিসের বিষয়ে আলোচনাসহ আরবী শিক্ষার কথা বলে রাজধানীর বিভিন্ন বাসায় একত্রিত হতো। সেখানেই তারা জঙ্গীবাদ, দলের তৎপরতা বাড়ানো, দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম, দলের ফা- গঠনের বিষয়ে আলোচনা করত। একজন র‌্যাব কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুরোপুরি জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর তারা নিয়মিত চাঁদা দিতে থাকে তাদের জঙ্গী সংগঠন নতুন জেএমবিকে। শুধু চাঁদা দেয়া নয়, তারা যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন জেএমবির সদস্য সংগ্রহের জন্য কাজ করছিল। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা জঙ্গীদের পৃথক পৃথক সাংগঠনিক নাম রয়েছে। এসব নাম জঙ্গী সংগঠনগুলোর তরফ থেকে দেয়া। সেইসব নাম কেবলমাত্র সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা অন্য জঙ্গীরাই জানে। সেই ছদ্ম নামেই তাদের সঙ্গে অন্য জঙ্গীদের যোগাযোগ হয়। যে জঙ্গীদের যোগাযোগ হয় তারাও ছদ্ম নামে পরিচিত। প্রকৃত নাম দলের কোন সদস্যের কাছে প্রকাশ না করতে, দলের কোন সদস্যের প্রকৃত নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা না করতে জঙ্গীদের শপথ করানো হয়। র‌্যাব বলছে, নতুন জেএমবির গ্রেফতারকৃত চার নারী সদস্যের সঙ্গে গত ২১ জুলাই র‌্যাবের হাতে গাজীপুর থেকে গ্রেফতারকৃত জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মোঃ মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানের যোগাযোগ রয়েছে। মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমেই নারী জঙ্গীরা তাদের চাঁদার টাকা মূল সংগঠনের কাছে হস্তান্তর করত। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক লুৎফুল কবির জানান, উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত আধুনিক তরুণ-তরুণীদের জঙ্গীবাদে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি অনেকটা ভাইরাসের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। এরজন্য প্রযুক্তির সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। গ্রেফতারকৃত চার নারী জেএমবি যার যার প্রতিষ্ঠানে দলের কার্যক্রম বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। তারা মূল সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা দিতো। কিভাবে দলের কার্যক্রম বাড়ানো যায় সেসব বিষয় নিয়ে বলতে গেলে তারা বিস্তর গবেষণা করত। তারা সরাসরি জেএমবিতে যোগদান করেছে, নাকি অন্যকোন দলের সদস্য হিসেবে পরিকল্পিতভাবে জেএমবিতে ঢুকে দেশে জঙ্গী তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে জানার চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারকৃতরা দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে মরিয়া হয়ে পড়েছিল। যেকোন মূল্যে তারা দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করছিল। সেক্ষেত্রে সশস্ত্র জিহাদ করতেও তারা প্রস্তুত ছিল। তারা জেএমবি সদস্য হলেও আইএসের অনুসারী। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য যেকোন ধরনের ত্যাগ শিকার করতে প্রস্তুত তারা। যা রীতিমতো ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নেপথ্যে মূলত কারা কাজ করছে তা জানার চেষ্টা চলছে।
×