ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাস মজুদের পরিমাণ আগের তুলনায় সাড়ে ৪ টিসিএফ বেশি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ আগস্ট ২০১৬

গ্যাস মজুদের পরিমাণ আগের তুলনায় সাড়ে ৪ টিসিএফ বেশি

রশিদ মামুন ॥ গ্যাসের অবশিষ্ট মজুদ আগের তুলনায় অন্তত সাড়ে চার টিসিএফ বেশি বলে মনে করছে হাইড্রোকার্বন ইউনিট। সম্প্রতি গ্যাসের রিজার্ভ (মজুদ) নির্ধারণ করে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের দেয়া প্রতিবেদনে এর উল্লেখ রয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ ১০ টিসিএফ গ্যাস অবশিষ্ট আছে উল্লেখ করা হলেও এখন বলা হচ্ছে সাড়ে ১৪ টিসিএফের বেশি অবশিষ্ট রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে হাইড্রোকার্বন ইউনিট এই প্রতিবেদন দেয়। এই মজুদে সর্বোচ্চ আর ১২ বছর চলতে পারে। তবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করবে। তবে এর থেকে আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে দেশের বড় খনিগুলোর মজুদ দ্রুত শেষ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঙ্কট সামাল দিতে এককভাবে বড় খনিগুলোর ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। যা খনিগুলোকে ধ্বংস করছে। গত সপ্তাহে সরকারের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয় এখন পর্যন্ত প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য মিলিয়ে দেশে গ্যাসের মজুদ রয়েছে ৩৫ দশমিক ৮০ টিসিএফ। তবে এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য বলে ধরা হয়েছে ২৮ দশমিক ৪৭ টিসিএফ। ইতোমধ্যে ১৩ দশমিক ৭০ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে ১৪ দশমিক ৭৬ টিসিএফ। পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, এখনই নতুন কিছু আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমাদের বিদ্যুত খাতে দেশের বেসরকারী খাত অংশ নিয়েছে কিন্তু জ্বালানি খাতে তা সম্ভব হয়নি। আবার আমাদের কয়লার দিকেও আমরা নজর দিচ্ছি না। শুধু আমদানির চিন্তা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি বদলে গেলে কি হবে তা চিন্তা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, এককভাবে শেভরন থেকে বেশি গ্যাস তোলার বিরোধিতা আমি আগে থেকেই করেছি। এতে ক্ষেত্রটির পরিণতি বন্ধ হয়ে যাওয়া সাঙ্গুর মতো হতে পারে। আমাদের দেশীয় ক্ষেত্রের উৎপাদন যদি আমরা বৃদ্ধি করতে পারি তাহলে এই সঙ্কট আর থাকবে না। কিন্তু ক্ষেত্রগুলোর ভবিষ্যত বিবেচনা করেই দেশীয় কোম্পানিগুলো তা করতে পারে না। কারণ এই সম্পদ আমাদের নিজেদের। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশীয় কোম্পানিগুলোর হাতেই বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানির হাতে তেমন মজুদ নেই। দেশীয় কোম্পানির মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির চেয়ে বেশি মজুদ রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কাছে। সব চেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে দ্রুত কমে যাচ্ছে শেভরণ বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত বিবিয়ানার মজুদ। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে বিবিয়ানার অর্ধেক গ্যাস এর মধ্যেই তোলা হয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে খনিটির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এতে সময়ের আগেই হয়ত খনিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। পেট্রোবাংলা বলছে প্রতিদিন এখন গড়ে দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এর মধ্যে এককভাবে একটি খনি বিবিয়ানা থেকে উত্তোলন করা হয় এক হাজার ২০০ মিলিয়নের বেশি। কোন কোন দিন উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়েও করা হচ্ছে। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক গ্যাসই একটি খনি থেকে তোলা হয়। ক্ষেত্রটির গ্যাস ফুরিয়ে গেলে বড় ধাক্কা খেতে হবে। ক্ষেত্রটির ওপর নির্ভর করে অন্তত তিনটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যার একটি উৎপাদনে এসেছে অন্যগুলো উৎপাদন শুরু করেনি। তবে ক্ষেত্রটিতে আরও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন করে কম্প্রেসার স্থাপনের পাঁয়তারা করছে শেভরণ। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্টরা এর বিরোধিতা করলেও কোন কাজে আসছে না। জ্বালানি মন্ত্রণালয় শেভরণ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বাপেক্সের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করা উচিত ছিল। দেশের নতুন নতুন ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে বাপেক্স তা পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে রয়েছে। অন্তত গত তিন বছর বাপেক্স নতুন কোন সুখবর দিতে পারেনি। এমনকি এর আগের পাঁচ বছর যেসব ক্ষেত্রে গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছিল তার মজুদও খুবই সীমিত। এর মধ্যে দুটি ক্ষেত্রের উৎপাদন বন্ধই করে দেয়া হয়েছে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা সুন্দলপুর এবং বেগমগঞ্জ ক্ষেত্র থেকে এখন আর গ্যাসই পাওয়া যাচ্ছে না। শুরুতে ক্ষেত্র দুটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেখালেও শেষে এসে দৈনিক ২/৩ মিলিয়ন ঘনফুট নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন উৎপাদন শূন্য অবস্থার রয়েছে ক্ষেত্র দুটি। আর আবিষ্কারের পর গ্যাস তুলতে যাওয়ার সাহস করতে না পারা ক্ষেত্র রূপগঞ্জের মজুদের পরিমাণ মাত্র ৩৩ বিসিএফ। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাপেক্সের হাতে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৫ টিসিএফ। তবে সবগুলো ক্ষেত্রের মজুদই একেবারে কম। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মজুদ দেখানো হচ্ছে সেমুতাং এ ৩০৬ বিসিএফ। তাদের হাতে আটটি গ্যাসের ক্ষেত্র রয়েছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির কাছে মজুদ রয়েছে প্রায় পাঁচ টিসিএফ। তাদের হাতে ৬টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কাছে অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ সাড়ে ৫ টিসিএফের কাছাকাছি। দেশের সব থেকে বড় এই দুই কোম্পানির হাতেই সব থেকে বেশি মজুদ রয়েছে। হাইড্রোকার্বন ইউনিট বলছে দেশের সব থেকে বড় গ্যাসক্ষেত্রটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস। এটির মজুদ ৩ দশমিক ৪৭ টিসিএফ মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে। এ গ্যাসক্ষেত্রটি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। দৈনিক তিতাস থেকে তোলা হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসের মজুদ রয়েছে রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে এটির মজুদ হলো ২ দশমিক ৫৬ টিসিএফ, এটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের। এখান থেকে ৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক তোলা হয়েছে। তবে একটি সূত্র বলছে রশিদপুর ক্ষেত্রটিতে পানি চলে এসেছে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাসের মজুদ রয়েছে বিবিয়ানাতে যার পরিমাণ ২ দশমিক ১৯৭ টিসিএফ। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি শেভরণের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেখা যায় বহুজাতিক কোম্পানি শেভরণের নিয়ন্ত্রণে এ ছাড়াও রয়েছে মৌলভীবাজার এবং জালালাবাদ ক্ষেত্র দুটি। তবে এই দুই ক্ষেত্রর মজুদ থেকেও সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্যাস উত্তোলন করছে তারা। দৈনিক জালালাবাদ থেকে ২৬২ মিলিয়ন ঘনফুট এবং মৌলভীবাজার থেকে ৪২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলছে শেভরণ। এর বাইরে বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লোর নিয়ন্ত্রণে থাকা বাঙ্গুরা ক্ষেত্রের মজুদও বেশ কমেছে। এখান থেকে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। অবশিষ্ট মজুদে আর খুব বেশি দিন গ্যাস পাওয়া যাবে না। এখানে ২৯২ বিসিএফ মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে বলে হাইড্রোকার্বন ইউনিট তাদের প্রতিবেদনে জানায়। সান্তোস বাংলাদেশের হাতে থাকা দেশের একমাত্র সমুদ্রবক্ষের গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে না। এ কূপ থেকে গ্যাসের সঙ্গে অতিরিক্ত বালি ওঠায় এটি পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে নাইকোর হাতে থাকা ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। নাইকো সিলেটের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে দুই দফায় বিস্ফোরণ ঘটানোর পর সরকার কানাডাভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটির কাছে আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্যাসের মূল্য বাবদ ৭৪৬ কোটি টাকা আদায়ে চাপ দিলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যায়। সেখানে এখন অভিযোগটি সালিশি পর্যায়ে রয়েছে। নাইকো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ফেনীর গ্যাসের দাম চাইছে। এ নিয়ে দেশের আদালতেও দুটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
×