ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রিও অলিম্পিকের আরেক দিক

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০১৬

রিও অলিম্পিকের আরেক দিক

রিও অলিম্পিক শুরু হয়েছে এবং এ পর্যন্ত তেমন কোন অঘটন ছাড়াই (খেলা সংক্রান্ত কিছু অঘটন ছাড়া) চলেছে। অথচ এই অলিম্পিক নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার কালোছায়া দীর্ঘদিন ধরে ব্রাজিলের আকাশজুড়ে ছিল। ব্রাজিল এত বিশাল আয়োজন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন বার বার উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি রিও ডি জেনিরোতে দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রাজিলের মানুষ আনন্দে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যায়। সাম্বা নৃত্যে মেতে ওঠে। কারণ এ যে তাদের জন্য দারুণ অহঙ্কার ও গর্বের ব্যাপার। অথচ ৭ বছর পর এই মানুষগুলোই আবার অলিম্পিক আয়োজনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা বিক্ষোভ করে। সভা সমাবেশ করে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। বলে এখানে অলিম্পিক আমরা চাই না। কেন এই দুই রকম চিত্র? কেন ২০০৯ সালে সাম্বা নৃত্য এবং ২০১৬ সালে বিক্ষোভ? কারণ ২০০৯ ও ২০১৬ সাল এক নয়। এর মধ্যে বহু জল গড়িয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ব্রাজিলের অর্থনীতিতে তেজ ও বীর্যের সঞ্চার ঘটেছিল। ৭ বছর পর সেই অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় রোগশয্যায় শায়িত মুমূর্ষু ব্যক্তির মতো। সাধারণ মানুষের কাছে এই ব্যয়বহুল অলিম্পিক হয়ে দাঁড়ায় বিশাল বোঝা। রীতিমতো অভিশাপ। শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনৈতিক সঙ্কটেও আজ জর্জরিত হচ্ছে ব্রাজিল। ২০০৯ সালে শিকাগো, মাদ্রিদ ও টোকিওকে হারিয়ে রিও ডি জেনিরো অলিম্পিক আয়োজক হওয়ার সুযোগ পায়। এর দুবছর আগে ব্রাজিলের উপকূলে শত শত কোটি ডলার মূল্যের তেলের সন্ধান মেলে। তাতে অর্থনীতির চেহারা আমূল পাল্টে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা তখন ক্ষমতার তুঙ্গে এবং বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক। দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে লাখ লাখ মানুষকে টেনে তুলে তিনি তেজী অর্থনীতির সুফল জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সবই তখন ঠিকঠাক মতো চলছিল বলে সবার কাছে মনে হচ্ছিল। কিন্তু অলিম্পিক মশাল আসার আগেই ব্রাজিলকে দুর্ভাগ্য গ্রাস করে। ব্রাজিলের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো আকরিক লোহা ও চিনি। ২০১৪ সালে বিশ্ববাজারে এগুলোর দাম পড়ে যায়। ফলে দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা নামে। জিডিপি সঙ্কুচিত হয়ে আসে ৩.৮ শতাংশে। এ বছর তা আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক শ্রেণীটি নানা দুর্নীতি ও স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়ে। দেশের ইতিহাসে দেখা দেয় বৃহত্তম দুর্নীতির ঘটনা। কয়েক ডজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোবাসের কর্মকর্তাদের কয়েকশ কোটি ডলার ঘুষ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। জনমনে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও সঞ্চারিত হয়। লুলার পছন্দের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট রুসেফের জনপ্রিয়তায় ধস নামে। এখন তার ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া চলছে। অর্থনীতি ও রাজনীতির এই সঙ্কট আরও হাজারো সমস্যার জন্ম দেয়। বেকারত্ব চরমে পৌঁছে। পুলিশ ঠিকমতো বেতন না পাওয়ায় কাজে ঢিলে দেয়। ফলে ডাকাতি-রাহাজানির মতো অপরাধ বেড়ে যায়। লাগামহীন দুর্নীতিতে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধসে পড়ে। এর সঙ্গে দেখা দেয় জিকা ভাইরাস আতঙ্ক যা বাইরের দর্শক ও অলিম্পিক ক্রীড়াবিদদেরও স্পর্শ করে। টিকেট বিক্রি পড়ে যায়। কিছু কিছু দুর্ঘটনা থেকে জনমনে ধারণা জন্মে যে, এই অলিম্পিক অভিশপ্ত। ওদিকে অলিম্পিকের কেন্দ্রবিন্দু রিও ডি জেনিরোর অবস্থাও ভিন্ন কিছু ছিল না। সাড়ে চারশ বছরের পুরনো ও ৬৩ লাখ লোক অধ্যুষিত রিও ছিল এক গ্ল্যামারাস নগরী ও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু ১৯৬০ সালে রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পর থেকে রিওর পতন শুরু হয়। নগরীর বাইরের সৌন্দর্য ও জৌলুস যাই থাক ভেতরটা পচে গিয়েছিল। চরম দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সংগঠিত অপরাধ নগরীর প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। সৈকত তীরবর্তী সুরম্য এপার্টমেন্টগুলোর অনতিদূরে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে যেসব বস্তি গড়ে উঠেছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সশস্ত্র মাফিয়াচক্র। এক কথায় রিওর সিংহভাগ এলাকাই এদের নিয়ন্ত্রণে। এসব এলাকা পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রতিশ্রুতি খুব একটা কাজে আসেনি। তারপরও চেষ্টা হয়েছে। নগরীর গুয়ান্তানামা বে’ যেখানে নৌকা প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা সেটা ছিল ঘোরতর দূষিত। দীর্ঘদিন ধরে নগরীর বেশিরভাগ বর্জ্য সেখানেই ফেলা হতো। রাজ্য সরকার স্থানটি পরিষ্কার করার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত সেটা কতটুকু রক্ষিত হয়েছে তাও প্রশ্ন। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও তেমন ভাল ছিল না। গত মে মাসে দিনে তিনশরও বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে রাস্তায়। ২০১২ সালের তুলনায় এ বছর বেড়েছে শতকরা ৮৫ ভাগ। হত্যাকা- অবশ্য কমে এসেছে। এসব অপরাধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হুমকিও ছিল। সবকিছু মোকাবেলায় রিওর রাস্তায় অলিম্পিক চলাকালীন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ৬৮ হাজার সদস্য মোতায়েনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ট্যুরিস্টও এথলেটদের নিরাপত্তার বিধানে। তারপরও যে কিছু অঘটন হয়নি তা নয়। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও আয়োজকরা যে শেষপর্যন্ত অলিম্পিকের শুভ সূচনা করতে পেরেছে এবং এখনও যে চালিয়ে যেতে পারছে সেটাও কম কথা নয়। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×