ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু অসাধু ডাক্তার ও দালাল চক্রের কারসাজি ॥ রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত

সরকারী হাসপাতালের রোগী নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৭ আগস্ট ২০১৬

সরকারী হাসপাতালের রোগী নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য

নিখিল মানখিন ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় শাহাদাত হোসেনকে (৩৪) ভর্তি করা হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পঙ্গু হাসপাতালে। তিনদিন পর জরুরী ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের তাগিদ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল পেতে দেরি হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চিকিৎসকরা রোগীকে মোহাম্মদপুর বাবর রোডের একটি বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে বাবর রোডের একটি হাসপাতালে রোগীকে অস্ত্রোপচার করানো হয়। এজন্য রোগীকে দিতে হয় ৭০ হাজার টাকা। সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকদের অসাধুতার কারণেই সহায় সম্বল ফুরাতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রোগীর চাচা আমজাদ হোসেনের। এভাবে শুধু ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার শাহাদাত নন, সারাদেশেই সরকারী হাসপাতালে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে চিকিৎসা এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর অভিযোগ উঠেছে অনেক সরকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। এতে করে একদিকে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা, অন্যদিকে চিকিৎসক ও দালালদের অমানবিক এ বাণিজ্যিক খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে রোগীর পরিবার। হাসপাতালের নিয়ম অমান্য করে অনেক চিকিৎসক নিজেদের চুক্তিবদ্ধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লভ্যাংশ। অবাক হওয়ার মতো বিষয়। রোগীর নাম কামরুজ্জামান। তিনি হার্টের জটিল সমস্যায় ভুগছেন। তিনি চিকিৎসার জন্য রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গেলেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি বিকেলে কাক্সিক্ষত সার্জারি বিভাগের এক সার্জনের দেখা পেলেন। রোগীটির পূর্বের কাগজপত্র দেখলেন তিনি। কিন্তু রোগীটিকে দেখলেন না। ‘ইকো’ করানোর জন্য তিনি পরামর্শ দিলেন। তবে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নয়, তা করাতে হবে ধানম-ির মেডিনোভায়। যে চিকিৎসকের কাছে রোগীটি যাবে, তার নামও প্যাডে লিখে দিলেন। কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে স্বল্প খরচে ‘ইকো’ করানোর ব্যবস্থা রয়েছে। খরচ পড়বে মাত্র ৬শ’ টাকা (কালার)। আবেদন সাপেক্ষে ফ্রি ইকো করানোরও ব্যবস্থা রয়েছে। আর একই পরীক্ষা মেডিনোভায় খরচ পড়বে ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। তবে চিকিৎসক কিছু কমিশনের সুপারিশ লিখে দিলেন। নিরূপায় হয়ে রোগীকে মেডিনোভায় নেয়া হয়। ইকো করাতে তাদের খরচ পড়ে ১৭শ’ টাকা। ওই চিকিৎসকের সহকারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অনেক সার্জন সরকারী হাসপাতালের ল্যাব পরীক্ষার ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাঁরা একেক জন একেক নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীকে পাঠিয়ে থাকেন। একই ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মহাখালীর সরকারী ক্যান্সার হাসপাতালেও। সরকারী হাসপাতালে কেমো থেরাপী দেয়ার জন্য কোন টাকা নেয়া হয় না। রোগীকে শুধু ওষুধ কিনে নিতে হয়। কুড়িলবাসী মোঃ আমজাদের ঠাঁই হলো না ক্যান্সার হাসপাতালে। এক সহযোগী অধ্যাপক তাঁকে দেখলেন। আর কেমো থেরাপি দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দিলেন ধানম-ির বেসরকারী প্যানোরোমা হাসপাতালে। রোগীকে ওই বেসরকারী হাসপাতালে ওষুধের খরচ ছাড়াও সিটভাড়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। পরবর্তীতে জানা গেছে, ওই হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের চুক্তি রয়েছে। অথচ মহাখালীর ক্যান্সার হাসপাতালে নামমাত্র খরচে কেমো থেরাপি দেয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। অনেক সরকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে মানবিক চিন্তার চিকিৎসকও অনেক আছেন। অভিযোগ রয়েছে, কার্যদিবসে অনেক সরকারী মেডিক্যাল শিক্ষক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কাজ করে থাকেন। দিনে নামমাত্র সময় দিয়ে থাকেন তাঁরা। দেশের বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সাইনবোর্ডে ছেয়ে গেছে সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকদের নাম। নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি সরকার হাসপাতালের রোগী নিজেদের চুক্তিবদ্ধ চিকিৎসালয়ে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক সরকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের মতো বড় বড় হাসপাতালকে কেন্দ্র করে রাস্তার উল্টো দিকে গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর এগুলোতে ছলে-বলে- কৌশলে ভাগিয়ে নেয়া হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। এ ক্ষেত্রে সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার, জরুরী বিভাগের চিকিৎসকরা ভূমিকা রাখছেন। এ কাজে সহায়তা করার জন্য অনেক সরকারী চিকিৎসক ও কর্মচারী পেয়ে থাকেন নির্ধারিত ফি। ওই সব অসৎ সরকারী চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সঙ্গে বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের গোপন সখ্য রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার চিকিৎসকের পাশাপাশি সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে দালাল চক্র। এভাবে শুধু রাজধানীতে নয়, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সরকারী হাসপাতালসমূহ কেন্দ্র করে এমন বাণিজ্য হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
×