ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ আগস্ট ২০১৬

আজ কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছন্দোময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে কবিতায় দেশ ও মানুষের কথা বলা বাঙালীর ও বাংলাভাষার অনন্য এক কবি শামসুর রাহমান। আপন কাব্যশৈলীর গুণে আবির্ভূত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কাব্যভুবনে সবচেয়ে আলোচিত কবির পরিচয়ে। সমকালীনতা ধারণকারী অনন্য প্রতিভায় উজ্জ্বল এই নাগরিক কবি ছিলেন বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। কাব্য রচনায় সৃষ্টি ও মননের জ্যোতির্ময় উপস্থাপনা তাঁকে দিয়েছে কবিতার বরপুত্রের উপাধি। আজ বুধবার দেশ, মাটি ও মানুষের কথা বলা এ কবির দশম মৃত্যুবার্ষিকী ও একাদশতম প্রয়াণ দিবস। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। শেষ হয় তাঁর ৭৭ বছরের জীবন পরিভ্রমণ। কবির প্রয়াণ দিবসের আগের দিন মঙ্গলবার কথা হয় তাঁর স্নেহধন্য পুত্রবধূ টিয়া রহমানের সঙ্গে। বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, সম্পর্কে শ্বশুর হলেও তিনি ছিলেন আমার বাবার মতো। আজও তাঁর ঘরের লিখতে বসার চেয়ার, টেবিলসহ সবকিছু একইরকম আছে। সবই আছে, শুধু মানুষটি নেই। জীবন থেকে হারিয়ে চলে গেলেন স্মৃতির পাতায়। ১৭ আগস্টের বিশেষ দিনটিতে পরিবারের সবাই নিমজ্জিত হয় তাঁকে হারানোর বেদনায়। এসব কথার পর শোকের বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে টিয়া রহমান বললেন, আজ বুধবার সকাল ৯টার পর পরিবারের পক্ষ থেকে কবির বনানীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া আজ বিকেলে নরসিংদীতে কবির গ্রামের বাড়ি পাড়াতলীর কলিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কবি শামসুর রাহমান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে আলোচনা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বনানীতে কবর জিয়ারত শেষে আমরা পরিবারের সবাই ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদও কবিকে স্মরণের ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়া আজ সকালে পরিবারের বাইরে প্রয়াণবার্ষিকীতে কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করবে জাতীয় কবিতা পরিষদ, শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের ৭৭ বছরের বর্ণময় জীবনের বড় অংশজুড়েই নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবিতার কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ভূমিকাটি একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। ষাটের দশকে গোড়ার দিকেই কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত করেন সাহিত্যের ভুবন। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতায় ধাবিত হলেও একটা সময়ে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন নিবিড় মমতায়। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত। ১৯৪৯ সালে শামসুর রাহমান লেখেন প্রথম কবিতা ‘১৯৪৯’। প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আর এই শুরুটা ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতার সৃষ্টিসম্ভার। পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই এপার-বাংলার কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলোÑ রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ ও আমি অনাহারী। অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও রাজনীতির দহন থেকে গা বাঁচিয়ে চলেননি এই কবি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। রচনা করেছেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। তাঁর রচিত বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থগুলোয় তীক্ষè ও প্রবলভাবে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড’ নামক কবিতা। সত্তরের নবেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ অথবা তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, একাত্তরের পটভূমিতে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, গেরিলা, কাঁক ইত্যাদি কবিতাগুলোয় উচ্চারিত হয়েছে এদেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ ও ইকারুসের আকাশ। যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্যভাষ্যকার। একইসঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কলম থেমে বেরিয়ে এসেছে গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বার বার বিতর্ক তুলেছে কূপম-ুুক মৌলবাদীরা। এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য শ্যামলীর বাসায় হামলাও করেছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। এত কিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসে অনড় ছিলেন। কবিতার চরণে চরণে বলেছেন সম্প্রীতির কথা। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন শামসুর রাহমান। এর বাইরে গীতিকার হিসেবেও তাঁর আরেকটি পরিচয়। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্তমিলে ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি, স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে, ফসলের মাঠে/মেঘনার তীরে, অনেক দিনের মতো এই দিন, এই মাটির কণা, স্বাধীনতা তুমি আছ বলে গোলাপ চামেলি ফোটে, এল নববর্ষ/শুভ নববর্ষ, বৈশাখী দিনে, ধুধু পিপাসার ক্ষণে, শূন্যে ডালে হঠাৎ হাওয়ায় লাগল ঝাঁকি, বৈশাখেরই অগ্নিঝালর দহন আনে জুড়ে, কথার ছলেই কথা দিয়েছিলে, মধুময় পৃথিবীকে নীলাকাশ ডাকবে, তোমার হৃদয়ে শ্রাবণের বর্ষণ, মেঘের কিনারে রঙধনু জাগে ইত্যাদি। শামসুর রাহমান রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬টি। উপন্যাস লিখেছেন চারটি। একটি করে রয়েছে প্রবন্ধ ও ছড়ার বই। অনুবাদ বইয়ের সংখ্যা ৬টি। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে মর্নিং নিউজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ ঘটে তাঁর। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এর মাঝে আবার ফিরে আসেন পুরানো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে নবেম্বর থেকে শুরু করে সরকারী দৈনিক দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগ বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অধুনার সম্পাদকের দায়িত্ব¡ পালন করেন। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেয়া হয়। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরান ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাস কোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নেননি।
×