ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেড় শতাধিক ধর্মীয় বিতর্কিত বই উদ্ধার

মারজান ইস্যুতে চবিতে তোলপাড় ॥ আরবী বিভাগে অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০১৬

মারজান ইস্যুতে চবিতে তোলপাড় ॥ আরবী বিভাগে অভিযান

রহমান শোয়েব, চবি ॥ গুলশান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সন্দেহের তালিকায় থাকা নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এমন খবরে ক্যাম্পাসজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মারজানের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। পুরো দিনই আরবী বিভাগ ও উপাচার্য কার্যালয়ে ভিড় করেন গণমাধ্যম কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আরবী বিভাগ ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে চলে অভিযান। উদ্ধার করা হয় বিতর্কিত লেখকদের বই। মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী- সোমবার এমন খবর গণমাধ্যমে প্রচার হলে তা নজরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার চবি উপাচার্যের ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের শিডিউল থাকলেও সোমবার রাতেই তিনি তা বাতিল করেন। মঙ্গলবার সকালেই তিনি ক্যাম্পাসে এসে মারজানের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। এতে মারজানের বিস্তারিত পরিচয় বেরিয়ে আসে। আরবি বিভাগের নথিপত্র ঘেঁটে মারজান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বের করা হয়। এরপর বেলা ১১টার দিকে উপাচার্য তার কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মারজানের প্রকৃত নাম নুরুল ইসলাম। বন্ধুদের মাঝে তিনি ফাহাদ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার একাডেমিক রোল বা আইডি নম্বর ১৩১০৭০৩০। তার একাধিক সহপাঠী জানান, মারজান প্রথম বর্ষে নিয়মিত ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে তিনি অনিয়মিত হয়ে পড়েন। এরপর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন সর্বশেষ ২০৫নং কোর্সের পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপরই তিনি নিখোঁজ হন। তবে মারজান খুব শান্ত স্বভাবের ছিল বলে দাবি তার সহপাঠীদের। তার কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোন তথ্যও জানাতে পারেননি তার সহপাঠীরা। চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘মারজানের প্রকৃত নাম নুরুল ইসলাম। তিনি চবি আরবি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় এবং তিনি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে তার ভর্তি বহু আগেই বাতিল করা হয়েছে।’ চবির অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকায় ছিল না মারজানের নাম ॥ জানা যায়, চলতি বছর ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী নিখোঁজ থাকলে তাদের তালিকা স্থানীয় হাটহাজারী থানায় জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন তৎকালীন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ইসমাইল। সে নির্দেশনা অনুযায়ী ১৫ জুলাই সকল বিভাগকে দশ দিন বা তার অধিক অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা করে তা রেজিস্ট্রার বরাবর জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেন রেজিস্ট্রার। ২১ জুলাইয়ের মধ্যে সব বিভাগকে তালিকা দিতে বলা হয় ওই চিঠিতে। অধিকাংশ বিভাগ অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা জমা দিলেও আরবি বিভাগ কোন তালিকা জমা দেয়নি। ফলে চবির অনুপস্থিত ছয় শিক্ষার্থীর যে তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেখানে ছিল না নুরুল ইসলাম বা মারজানের নাম। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা দেয়নি সাতটি বিভাগ ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগকে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা দিতে বলা হলেও আরবি বিভাগসহ সাতটি বিভাগ এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত তালিকা দেয়নি বলে জানা গেছে। চবি উপাচার্য জানান, ‘এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত থেকে আটটি বিভাগ অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি। তারা কেন তালিকা দেয়নি সে ব্যাপারে জবাব চেয়ে আজই (মঙ্গলবার) সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হবে।’ তিনি জানান, ‘আরবী বিভাগের সভাপতি অসুস্থ থাকায় তিনি ছুটিতে ছিলেন। তাই সেই বিভাগের তালিকা তারা পাঠাতে পারেননি। তবে আর কোন শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন অনুপস্থিত আছে কি-না, সে ব্যাপারে আগামীকালের (আজ বুধবার) মধ্যে আরবি বিভাগকে তালিকা জমাদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ খোঁজ মিলেছে অনুপস্থিত ছয় শিক্ষার্থীর ॥ গত ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপস্থিত ছয় শিক্ষার্থীর তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই তালিকায় যাদের নাম ছিল প্রাথমিকভাবে তাদের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রী গত বছর বিয়ের পর সন্তানসম্ভবা হওয়ায় আর ক্লাসে আসেননি। এছাড়া তিনি একটি কলেজে ভর্তি হয়ে হোমিওপ্যাথিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। পরে অনুুপস্থিত শিক্ষার্থী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রক্টরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এছাড়া ফার্মেসি বিভাগে দুজন শিক্ষার্থী ৭ আগস্ট বিভাগীয় সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং একটি পরীক্ষায় অংশ নেন। দর্শন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বিদেশে আছেন। তালিকায় তার নাম থাকায় তিনিও তার বিভাগ ও প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এছাড়া ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি হয়েছেন এবং অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে তাদের অনুপস্থিতির কারণ জানিয়ে নিজ নিজ বিভাগে লিখিতভাবে তা জমা দিয়েছেন বলেও জানা যায়। আরবি বিভাগে অভিযান, বিতর্কিত বই উদ্ধার ॥ সোমবার মারজানের নামটির সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জড়িত হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। মঙ্গলবার এরই অংশ হিসেবে অভিযান চালানো হয় আরবি বিভাগের সেমিনার কক্ষে। সেখানে জামায়াতের আধ্যাত্মিক নেতা মওদুদীসহ নিজামী, সাঈদীর লেখা বইসহ ধর্মীয় উগ্রতা ছড়ায় এমন প্রায় দেড় শতাধিক বই উদ্ধার করা হয়। পরে এসব বই প্রক্টরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে গত ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, বিভাগীয় লাইব্রেরীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও মসজিদগুলোর সংগ্রহে থাকা বইয়ের তালিকা জমা দিতে বলা হয়। এ বিষয়ে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন জঙ্গীদের দখলে ছিল। আমরা সে অবস্থার পরিবর্তন করেছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল, মসজিদে ধর্মীয় উগ্রতা ছড়ায় এমন বইয়ে ভরপুর করেছিল। আমরা সেগুলোর পরিবর্তন এনেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বইয়ের তালিকা জমা দিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, হল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর দায়িত্বরতদের চিঠি দিয়েছিলাম। এরপর আমরা বেশকিছু নিষিদ্ধ ও বিতর্কিত বই এসব স্থান থেকে সরিয়েছি।’ তবে আরবি বিভাগ বইয়ের তালিকা জমা দিলেও বেশকিছু বইয়ের তালিকা তারা জমা দেয়নি। মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে তালিকার বাইরেও বহু বই উদ্ধার করা হয় সেমিনার লাইব্রেরী থেকে। এ বিষয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সহকারী প্রক্টর লিটন মিত্র জানান, ‘আরবি বিভাগ থেকে বইয়ের যে তালিকা দেয়া হয়েছিল এখানে তার বাইরেও কিছু বই উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা সেগুলো জব্দ করেছি। আর এসব বই কিভাবে এখানে আছে সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হবে।’ ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেও কিছু বিতর্কিত লেখকের বই পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ॥ মারজান ইস্যুতে মঙ্গলবার সারাদিন ক্যাম্পাসে তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ বেলাল, সার্কেল এএসপি লুৎফুর রহমান, এডিশনাল এএসপি মশিউদ্দৌল্লাহ উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া র‌্যাব সদস্যরাও সাক্ষাত করেন উপাচার্যের সঙ্গে। মঙ্গলবার দিনব্যাপী বিভিন্ন বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আরও নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
×