ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একান্ত আলাপে বাউল মুনির সরকার

মানুষ যে বোঝে না স্রষ্টা তার কাছ থেকে দূরে সরে যান

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৭ আগস্ট ২০১৬

মানুষ যে বোঝে না স্রষ্টা তার কাছ থেকে দূরে সরে যান

মোরসালিন মিজান ॥ বাউল মনির সরকারের রাজধানী শহরেই বাস। বহুকাল ধরে আছেন। তবে তার মতে, বাউল গ্রাম বা শহরে থাকে না। বাউল থাকে মনে। জাগতিক চাওয়া পাওয়ার বাইরে গিয়ে নিজের মনকে গড়ে নিয়েছেন তিনি। প্রায় দেড় হাজার গানের গীতিকার সুরকার আত্মার মুক্তির জন্য গান করেন। পরমাত্মার সন্ধানে ছুটে বেড়ান। কিন্তু এই শান্তিটুকুও যখন কেড়ে নিতে চায় ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠী তখন বেদনার শেষ থাকে না। একান্ত কিছু ব্যথা বেদনাও ভেতরে পুষে রাখেন। এই যেমন, তার নিজের লেখা সুর করা কত গান এখানে ওখানে বাজছে। বিপুল জনপ্রিয়। অথচ তার খোঁজ কেউ নেয় না। গীতিকার সুরকারের জায়গায় ‘সংগৃহীত’ লিখে চালিয়ে দেয়া হয়। ৫০ বছরের সঙ্গীত সাধনার পরও তাই আড়ালে থেকে যান মনির সরকার। অতি সম্প্রতি শ্রোতাপ্রিয় একাধিক গানের সূত্র ধরে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। জানা যায়, বাউলের মন সাধনা ও সমকালীন চিন্তার জগতটি সম্পর্কে। নিভৃতচারী বাউলের একটি গানের কথা আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাহলে মনির সরকারকে চেনা সহজ হবে। প্রতি কণ্ঠে গীত হওয়া গানটি- একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার/কেন বান্ধ দালান ঘর...। দেহতত্ত্ব ধারার আরেকটি গান এরকম- হাওয়ার উপর চলে গাড়ি লাগে না পেট্রোল ডিজেল/মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল/চমৎকার গাড়ির মডেল গো চমৎকার গাড়ির মডেল/মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল...। দুটি গানই রেডিও টেলিভিশনে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে। তারও বেশি জনপ্রিয় ইউটিউবে। গানের কথা গভীরে ছুঁয়ে যায়। মর্মমূল স্পর্শ করে। সুরের টানও অদ্ভুত। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা ফিউশন করে গাইছেন। লুফে নিচ্ছেন শ্রোতা। শিল্পীর উন্নত চেতনা ও বোধের প্রশংসা হচ্ছে। কিন্তু গানের যিনি মূল মালিক তিনি আড়ালেই থেকে যান। এভাবে এমনকি এই ধারণা হয় যে, তিনি সিলেট কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রয়াত বাউলদের একজন! তবে প্রতিটি গানের শেষাংশে লোকগানের রীতি অনুযায়ী, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে মনির সরকারের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই নামের সূত্র ধরে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর জানা যায়, ঢাকার জুরাইনে থাকেন প্রচারবিমুখ এই বাউল সাধক। কয়েকদিন আগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এইটুকুন ঘর। মেঝেতে মামুলি বিছানা পাতা। তার ওপর বসে বেহালায় যে সুর তুলছিলেন তিনি, এক কথায় অনবদ্য। চার দেয়ালের ভেতরে বসে, আহা, কী সুন্দর মাটিরগান! মানুষটাও মাটির। অতি সাধারণ দেখতে মনির সরকার। কীভাবে তৈরি হলো এই বাউল মন? জানতে চাইলে পেছনে ফিরে যান তিনি। বলেন, বাবা গান করতেন। তিনিই ছিলেন আমার বীজতলা। তার প্রভাবেই মাত্র আট বছর বয়সে গান আমারে পেয়ে বসে। ঢাকার কাছেই রূপগঞ্জে জন্ম। চাঁদপুরের মতলবে কাটে শৈশব। তখন থেকেই সুরে মজে ছিলাম। ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করছি। কিন্তু সঙ্গীতের নেশার কাছে সব ব্যর্থ হয়ে যায়। গান করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াই। তার পর ফিরে আসি ঢাকায়। ইট সিমেন্টের জঙ্গলে বসে গান হয়? এমন প্রশ্নে সুন্দর উত্তর করেন তিনি। বলেন, বাউল শহরে বাস করে না। গ্রামেও না। বাউল বাস করে মনে। মনের যত কথা, গানে বলি। এই গান সাধনা। পরমাত্মার সন্ধান করতে গানকে আশ্রয় করি আমরা। কথা বলতে বলতেই গানের খাতা উল্টান। প্রতি পাতায় মনের কত ভাব যে লিখে রেখেছেন! মনির সরকার জানান, ৫০ বছরের সঙ্গীত জীবনে দুই হাজারের মতো গান লিখেছেন। সুর করেছেন। কিন্তু সব গান সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় তার অনেক গানের খাতা নষ্ট হয়ে যায়। এখন গান আছে দেড় হাজারের মতো। নিজে গান করেন। করেন বটে। সঙ্গীতের আলোকোজ্জ্বল আসরে, প্রচলিত মিডিয়াগুলোতে ডাক পরে না। দুঃখ করে তিনি বলেন, একসময় রেডিও টেলিভিশনে গাইতে চাইতাম। কিন্তু অডিশন দিতে গিয়ে জানলাম, বড় কারও সঙ্গে জানাশোনা থাকতে হবে। আমি বড় মানুষ কোথায় পাব? এর পর থেকে বিভিন্ন আসরে গেয়ে বেড়াই। সাধারণ শ্রোতারা আমার গান পছন্দ করেন। আমার তাতেই খুশি। মনির সরকার সাধারণের ভালবাসা নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান। ‘সাইকেল’ চালিয়েই পৌঁছতে চান আপন গন্তব্যে। কিন্তু বাউল সাধকদের এই সরল চাওয়া এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী দেশের বিভন্ন স্থানে বাউলদের ওপর আক্রমণ করছে। সত্য সুন্দরের পূজারী অসাম্প্রদায়িক বাউল বলেন, এটা আমাদের একটা বিরাট দুঃখ। বাউলরা একতারা নিয়ে থাকে। গান নিয়ে থাকে। কারও সঙ্গে মারামারি করে না। এর পরও কেন বাউলদের ওপর হামলা? জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা ভুল কিছু করলে সামনে দাঁড়িয়ে বলুক। সেটা তো করে না। তার মানে, ওদের দুর্বল চিত্ত। ভুলে ভরা। কথার ফাঁকে ফাঁকে আরও অনেকগুলো জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনান তিনি। বলেন, আমরা তো গানে মানুষের কথা বলি। মানুষে মানুষে প্রেম প্রত্যাশা করি। মানুষ হবে সৎ মানুষ। সুন্দর মানুষ। কোন ময়লা মনে থাকবে না। অন্যের অনিষ্ট করবে না। কিন্তু এই মানুষ কই পাই? মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম কমে যাচ্ছে। ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। মানুষকে যে বুঝে না, সে কী করে স্রষ্টাকে বুঝবে? স্রষ্টা তার কাছ থেকে দূরে সরে যান। কিছু গানের মানুষের ওপরও অভিমান আছে তার। সমকালীন তরুণ গায়করা তার কাছে আসেন। গান নিয়ে যান। কণ্ঠে তুলেন। কিন্তু কেউ কেউ তার গান নিজের গান চুরি করেন। নিজের বলে চালিয়ে দেন। গীতিকার সুরকারের নাম না ‘সংগ্রহ’ দেখান। মনির সরকার এমনটি আর দেখতে চান না। সামান্য চাওয়া কি পূরণ হবে তার?
×