ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিজ বোমা হামলার সেই কলঙ্কময় দিন আজ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৭ আগস্ট ২০১৬

সিরিজ বোমা হামলার সেই কলঙ্কময়  দিন আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আজ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি কর্তৃক দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার এগারো বছর। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপত বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। সিরিজ বোমা হামলা করতে ১২শ’ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। ফান্ডের সিংহভাগ টাকা এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে। বাকি অর্থ যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি রাজনৈতিক দল ছাড়াও বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে যোগান দেয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নিলে দেশে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে। দেশব্যাপী একের পর হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। এরমধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এমন ঘটনার পর বিএনপি হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করতে থাকে। এতে করে জঙ্গীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর আগে গণমাধ্যমের তরফ থেকে সর্বহারা নিধনের নামে দেশে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের উত্থান হচ্ছে বলে বলা হয়। সেই জঙ্গীবাদের শীর্ষ নেতা জেএমবির বাংলা ভাই বলেও জানানো হয়। এ সময় তৎকালীন সরকারের তরফ থেকে বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জেএমজেবি ও জেএমবিকে নিষিদ্ধ করে। প্রথম দিকে বিএনপি জামায়াতের পরোক্ষ মদদে সংগঠিত হয়ে ওঠা জেএমবি সারাদেশে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় জেএমবি মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে দেশের ৬৩ জেলায় বেলা ১১টায় সিরিজ বোমা হামলা চালায়। দেশের ৩শ’ স্থানে মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে একযোগে ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দু’জন নিহত ও দুই শতাধিক লোক আহত হয়। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী-আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে। হামলার স্থান সমূহে জেএমবির লিফলেট পাওয়া যায়। লিফলেটগুলোতে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। তাতে লেখা ছিল, দেশের কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠালাম। দ্রুত দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমত কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব যারা বিচারক আছেন তারা তাগুতি (মানুষ সৃষ্ট) আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন। নতুবা আরও ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ সর্তকবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে। সিরিজ বোমা হামলায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৬১ মামলা হয়। সিরিজ বোমা হামলার কিছুদিন পর আবার শুরু হয় ধারাবাহিক হামলা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের জেলা আদালতে বিচারকাজ চলাকালীন সময়ে একযোগে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এজলাসে ঢুকে বিচারককে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারা হয়। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর সিলেটের দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে হত্যা করতে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। ওই বছরের ১৫ নবেম্বর ঝালকাঠি শহরের অফিসার্স পাড়ায় জাজেস কোয়ার্টারের সামনে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসে শক্তিশালী বোমা হামলা করে ঝালকাঠি জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাড়েকে হত্যা করে জেএমবি। ওই বছরের ৩০ নবেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রাম আদালতে পৌনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে আত্মঘাতী জেএমবি সদস্যরা গায়ে বোমা বেঁধে হামলা চালায়। এতে ২ জঙ্গীসহ ৯ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। ওই বছরের ২ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলা আদালতে চায়ের ফ্লাক্সে করে বোমা হামলা করে সাত জনকে হত্যা ও অর্ধশত জনকে আহত করে জেএমবি। সিরিজ বোমা হামলার পর গ্রেফতার হয় শীর্ষ জঙ্গী জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমান, জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, হুজি প্রধান মুফতি হান্নান, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল, আব্দুল আউয়াল ওরফে আদিল, জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান ওরফে সানি, জেএমবির শূরা সদস্য হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদ, মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদ, ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সিরাজ ওরফে আমজাদ, জেএমবির সামরিক শাখার আরেক কমান্ডার মোঃ মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে বশির, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মোঃ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমা মিজান (বর্তমানে পলাতক), জেএমবির আইটি শাখার প্রধান বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ এমরানুল হক ওরফে রাজীব ওরফে মঈনুল ওরফে আবু তোবা ওরফে ইকবালসহ অনেকেই। আতাউর রহমান সানির বরাত দিয়ে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জেএমজেবি গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকা এসেছে বিদেশ থেকে। যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অনেক এনজিও এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীও নানাভাবে জড়িত। ঝালাকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ সাত শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর হয়। তার পরেও থেমে নেই জেএমবির তৎপরতা। ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে পুলিশ হত্যা করে তিন জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেয়া, গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলা এবং শোলাকিয়ার হামলার ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছে জেএমবি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীরা নতুন করে সব জঙ্গী সংগঠনকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এজন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোকে প্রযুক্তি নির্ভর করা হয়েছে। জঙ্গী সংগঠনগুলোতে চৌকস ও মেধাবীদের টানা হচ্ছে। এজন্য নতুন করে আবারও আলোচনা চলে এসেছে জেএমবি। কারণ একমাত্র জেএমবি ও হুজির কাছেই মারাত্মক অস্ত্রগোলাবারুদ তৈরির প্রযুক্তি রয়েছে। এছাড়া জঙ্গী সংগঠন দুইটির অনেকেই পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
×