ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ ঐশীসহ চার নারী জেএমবি সদস্য গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ আগস্ট ২০১৬

ডাঃ ঐশীসহ চার নারী জেএমবি সদস্য গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নতুন জেএমবির নেত্রী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশী ও আকলিমা রহমানসহ চার নারী সদস্য র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আকলিমা, মৌ ও মেঘনা জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বেসরকারী মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এমন ঘটনার পর হালে জঙ্গী কর্মকা-ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের পর মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়টির নামটিও জোরেশোরেই আলোচনায় এসেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, ভিডিও বার্তা, জিহাদী বক্তৃতা, জিহাদে প্ররোচণামূলক নথিপত্র সংবলিত মোবাইল ও ল্যাপটপ। মঙ্গলবার র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক লুৎফুল কবীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত ২১ জুলাই জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মোঃ মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসান (২৭) গাজীপুর জেলার টঙ্গী থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। জিজ্ঞাসাবাদে হাসান জানায়, নতুন জেএমবির কার্যক্রমে নারীরাও কাজ করছে। সে নতুন জেএমবিতে কাজ করা বেশ কিছু নারী সদস্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়। এমনকি সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে নারী সদস্যরা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে থাকে। চাঁদার টাকা নতুন জেএমবির পুরুষ শাখার মধ্যেও প্রয়োজনে আদান-প্রদান হয়। হাসান বেশ কয়েকজন নারী জেএমবি সদস্যদের নাম প্রকাশ করে। গত ১৫ আগস্ট দীর্ঘদিন গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখার পর নতুন জেএমবির নারী নেত্রী আকলিমা রহমানকে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকার নিজ বাড়ি থেকে সোমবার রাত দুইটার দিকে গ্রেফতার করা হয়। আকলিমার কাছ থেকে জব্দ করা হয় তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি। সেই মোবাইলে জঙ্গীবাদ ও জিহাদ সংক্রান্ত বিপুল পরিমাণ তথ্য রয়েছে। আকলিমা দেড় বছর ধরে জিহাদী দলটির সঙ্গে জড়িত। সে মাহমুদুল হাসান ওরফে তানভীরের হাত ধরে জঙ্গীবাদে নাম লেখায়। বাইয়াত (শপথ) গ্রহণের পর আকলিমা পুরোদমে নতুন জেএমবির হয়ে কাজ শুরু করে। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে সে দলকে বড় করার উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি ত্রাস সৃষ্টি করে সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইয়ানত (চাঁদা) সংগ্রহ করছিল। চাঁদার টাকা মাহমুদুল হাসানের নিকট পৌঁছেও দিত। গত রমজান মাসে আকলিমা ১২ হাজার টাকা তানভীরের কাছে দিয়েছে। আকলিমা গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকার স্থানীয় রেনেসা প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুলে ১৯৯৮ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। ২০০২ সালে তৃতীয় শ্রেণী পাস করে। ২০০৩ সালে তারা সাইনবোর্ড এলাকার হাজী আহাম্মদ আলী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়ে ২০০৪ সালে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। ২০০৫ সালে উত্তরা হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১০ সালে জিপিএ ৪.১৯ পেয়ে এসএসসি পাস করে। ২০১০ সালে হলি সাইন্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১২ সালে জিপিএ ৪.৭০ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। এরপর বিভিন্ন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে চেষ্টা করে ভর্তি হতে না পেরে ২০১৩ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ^বিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়টির চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে পড়ত। মানারাত ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি আরবী অধ্যায়ন করতে বিভিন্ন স্থানে জড়ো হতো। সেসব জায়গায় নতুন জেএমবির দাওয়াতী কার্যক্রম চালাত। আকলিমার তথ্যমতে সোমবারই রাজধানীর মগবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ঐশীকে। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ থেকে জিহাদী কর্মকা- চালানোর নানা আলামত জব্দ হয়। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ জিহাদী তথ্য সংবলিত বহু ফাইল, ম্যাগজিন, লেকচারের ভিডিও চিত্র। ঐশী চাঁদার ১২ হাজার টাকার মধ্যে ৮ হাজার টাকা ইতোমধ্যেই নতুন জেএমবির কাছে দিয়েছে। সে তিন বছর ধরে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। নতুন জেএমবির নারী ইউনিটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঐশী ও আকলিমার কাছ থেকে আসত। ঐশী ১৯৯৮ সালে ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তীতে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসে ভর্তি হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার এমবিবিএস শেষ হয়। চলতি বছরের জুন থেকে ডিএমসিতে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিল। তার পিতা ডাঃ বিশ্বাস আকতার হোসেন (৫৮) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। মা ডাঃ নাসিমা সুলতানা (৪৮) ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতালের গাইনি বিভাগে কর্মরত। আকলিমা ও ঐশীর তথ্য মোতাবেক রাজধানীর পাইকপাড়ার জনতা হাউজিং থেকে গ্রেফতার হয় মৌ। সে কিন্ডার গার্টেনে লেখাপড়া শুরু করে। মিরপুর-২ নম্বরে অবস্থিত ইসলামীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে। এরপর ২০১২ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে অবস্থিত বিসিআইসি কলেজ থেকে জিপিএ ৪.৬০ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। মেডিক্যাল ও ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য ইউসিসি (ফার্মগেট শাখা) কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। ২০১৩ সালে মানারাত ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিষয়ে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হয়। অনার্স শেষ বর্ষ সপ্তম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত ছিল। সে সাত মাস ধরে জিহাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। তার মোবাইলের মেমোরি কার্র্ড ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে তার থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপ থেকে জিহাদী দলিল দস্তাবেজ মিলে। এছাড়া জিহাদী বইপুস্তকও উদ্ধার হয়। মৌ মূলত আকলিমার মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়ায়। সোমবার রাত দশটায় রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর জনতা হাউজিংয়ের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার মোবাইল ফোনেও একই ধরনের জিহাদী বই, জিহাদী বক্তৃতা, ভিডিও ও জিহাদী নির্দেশনার ভিডিও পাওয়া যায়। আকলিমা ও মৌর মাধ্যমে মেঘনা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। পরে মেঘনাকেও ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সে সুরিহারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ২০০৪ সালে ৫ম শ্রেণী পাস করে। ২০০৬ সালে আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ২০১১ সালে জিপিএ ৪.৬৩ পেয়ে এসএসসি পাস করে। পরবর্তীতে ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে জিপিএ ৪.৭০ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। এরপর ২০১৩ সালে মোঃ রোকনুজ্জামানের সঙ্গে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। মেঘনা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ রায় ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের ম্যাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই দেশে একের পর এক ব্লগার, মুক্তমনা লেখক, প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা শুরু হয়। সর্বশেষ গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় ১৭ জন বিদেশী, দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাতে হামলার চেষ্টাকালে জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ সদস্য। তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, প্রতিটি ঘটনার পেছনেই স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের গঠিত দলটি এর নেপথ্যে কাজ করছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জঙ্গী শিক্ষার্থী গ্রেফতারের পর নতুন করে আলোচনায় জন্ম হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে জামায়াতের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জঙ্গীবাদী কোন তৎপরতা আছে কিনা তা নিয়ে। সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে জামায়াতের ১২৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম আসে। সেই তালিকায় রয়েছে মানারাত ইউনিভার্সিটির নামও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা করে। তাতেও রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম। বেসরকারী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্তরা প্রকাশ্য। বহুবার জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচীতে দেখা গেছে এর কর্ণধারদের। এর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির অন্যতম পরামর্শক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। অন্যতম সদস্য হিসেবে আছেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইবনে সিনা ফার্মাসিটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামায়াত নেতা এ এন এম এ জাহের, বর্তমান উপাচার্য ড. চৌধুরী মাহমুদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মানারাত ইন্টারন্যশনাল স্কুলও রয়েছে। সূত্র বলছে, জঙ্গী হিসেবে মানারাতের তিন নারী সদস্য গ্রেফতারের পর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের দৌড়ঝাঁপ আরও বেড়ে যায়। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা সারোয়ার জানান, আটককৃত তিন ছাত্রী মানারাতের বলে প্রাথমিকভাবে শোনা গেছে। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
×