ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাকে আঘাত দেয়ার জন্যই ১৫ আগস্ট জন্মদিন বেছে নেয়া হয়েছিল ॥ প্রধানমন্ত্রী

অঝোরে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী, শোকে নিস্তব্ধ সভা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৭ আগস্ট ২০১৬

অঝোরে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী, শোকে নিস্তব্ধ সভা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাবা-মা-ভাইসহ একরাতে পরিবারের সব স্বজন হারানোর দুঃসহ ব্যথা-যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, কাঁদালেন সবাইকে। রক্তাক্ত ১৫ আগস্টে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিন পালনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদারতা থেকে এবার উনি (খালেদা জিয়া) জন্মদিন পালন করেননি, এটা ঠিক নয়। বাস্তবতা ভিন্ন। ১২ আগস্ট তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্মদিন। কোকোর জন্মদিন যেহেতু করতে পারবেন না, সে মারা গেছে। কাজেই নিজেরটা করবেন না, এটাই হলো বাস্তব কথা। আর ১৫ আগস্ট তো উনার জন্মদিন নয়। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে আর আমাদের আঘাত দেয়ার জন্যই উনি ১৫ আগস্টকে বেছে নিয়েছিলেন ফুর্তি করার জন্য। মঙ্গলবার রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, দেখলাম উনি (খালেদা জিয়া) জন্মদিন পালন করবে না। যার জন্মদিন এই তারিখে না, শুধুমাত্র আমাদের আঘাত দেয়ার জন্য, যে দিনটাতে আমরা শোকে কাঁদি। বাবা হারিয়েছি, মা হারিয়েছি, ভাই হারিয়েছি- সেই ব্যথা নিয়ে যাতে বেঁচে না থাকি সেজন্যই আরেকজন (খালেদা জিয়া) কেক কেটে সেজেগুজে মিথ্যা জন্মদিন পালন করে। কালকে (সোমবার) শুনলাম উনি এবার জন্মদিন করবেন না। কেউ কেউ আবার এটাকে রাজনৈতিকভাবে তাঁর উদারতা দেখাতে চাচ্ছেন। কিন্তু আসল ঘটনাটা কি সেটা তো আমি জানি। তিনি বলেন, ১২ আগস্ট যেহেতু তাঁর ছেলের জন্মদিন। আর ছেলে মারা গেছে। মা হয়ে আর কি করবেন? সেজন্যই পালন করছেন না। এখানে কোন রাজনৈতিক উদারতা নেই। কেউ যদি এটা মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। তবে কিছু কিছু নেতা এটা দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বাস্তবতা তা না। আর এটা তো তাঁর জন্মদিন না। পাসপোর্টে তাঁর জন্ম তারিখ অন্য। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জীবন বৃত্তান্তে অন্য তারিখ রয়েছে। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য, আর আমাদের আঘাত দেয়ার জন্য এই দিনটাকে উনি বেছে নিয়েছিল ফুর্তি করার জন্য। উনি ১৫ আগস্ট দিনটাতে উৎসব করে খুনীদের জানিয়ে দেন যে, সে তাঁদের সঙ্গেই আছে। সেটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আকাক্সক্ষা পূরণই আমার একমাত্র প্রতিজ্ঞা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার সেই আকাক্সক্ষা পূরণে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। ১৫ আগস্টের পর থেকে এই দেশ ২১ বছর শোষিত নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে। আমি সব হারিয়েছি। কিন্তু সব হারাবার বেদনা নিয়েও একটা শক্তি নিয়ে কাজ করি বড় সন্তান হিসেবে। এই দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে। আমার বাবার যে স্বপ্নগুলো ছিল তা জানার এবং বোঝার সুযোগও আমার হয়েছিল। শুধু একটা কথাই মনে করি, এই কাজগুলো করলে, দেশের মানুষ ভাল থাকলে, আমার আব্বার আত্মা শান্তি পাবে। উনি নিশ্চয়ই এটা বেহেশত থেকে দেখতে পাচ্ছেন- বাংলাদেশের মানুষ যারা ক্ষুধার্ত ছিল, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, রোগে ওষুধ পেত না- তারা আজ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই নির্যাতিত নিপীড়িত ক্ষুধার্ত মানুষদের এতটুকু সেবা করতে পারি, তারা যদি একটু ভাল থাকে- আমি জানি এতেই আমার আব্বার আত্মা খুশি হবে, শান্তি পাবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য এস এম কামাল হোসেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কবিতা আবৃত্তি করেন সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্টের আগে ও পরের ঘটনাবলী এবং সব হারানোর ব্যথা-বেদনার কথা বলতে গিয়ে বার বার আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। পুরো বক্তব্যের সময়ই ছিল পিনপতন নীরবতা। প্রধানমন্ত্রীর কান্না দেখে হলভর্তি নেতা-কর্মীরাও নিজেদের চোখের পানি আটকাতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর আবেগজড়িত বক্তব্যের সময় পুরো মিলনায়তনেই আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় দিন। এদিন ব্যক্তিগতভাবে আমি হারিয়েছি আমার মা, বাবা, ভাইসহ স্বজনদের। আর জাতি হারিয়েছে ভবিষ্যত। তবে বার বার আমার প্রশ্নে উঠে, কেন এই হত্যাকা-? কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পাই না। আবেগজড়িতকণ্ঠে তিনি বলেন, ১০ বছরের আমার ছোট্ট ভাই রাসেল কি অপরাধ করেছিল? জন্মের পর থেকে সে বাবার স্নেহ পায়নি। বাবাকে চেনা, তাঁর হাত ধরে স্কুলে যাওয়ারও সুযোগ হয়নি রাসেলের। খুঁজে পাই না কেন এই হত্যাকা-? কী অপরাধ ছিল আমার মায়ের। আসলে এই হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য ছিল একটাই-যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় চায়নি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল- সেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দেবার লক্ষে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। তিনি বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে স্বামীর কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য দেশ ছেড়েছিলাম। জানি না কেন সেদিন মায়ের কি আকুল কান্না, আজও ভুলতে পারি না। মাকে এভাবে কান্না করতে কখনও দেখিনি। জানি না মা হয়ত সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন এটাই আমাদের শেষ দেখা। তাই হয়ত এত কেঁদেছিলেন। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ১৩ আগস্ট মায়ের সঙ্গে আমার টেলিফোনে শেষ কথা হয়। তখন মা আমাকে বলেছিলেন- তুই আয়, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। মায়ের সেই কথা আর শোনা হয়নি। আর বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় ১৪ আগস্ট। ১৫ আগস্টের ভয়াল ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট ভয়াল রাত্রির কথা যুগোশ্লোভিয়া থেকে শোনা যায় যে, বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। তখন আমি আর্তনাদ করে উঠি তবে কী আমাদের কেউ বেঁচে নেই? তখনও জানতে পারিনি ঠিক হয়েছে দেশে। স্মৃতিতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, তখন যিনি বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের পরে ওই রাষ্ট্রদূতের কাছে আমরা বোঝা হয়ে গেলাম। আমরা বেলজিয়াম থেকে জার্মানি যাওয়ার জন্য তার (রাষ্ট্রদূত) কাছ থেকে গাড়ির সহযোগিতাটুকুও পাইনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই রাষ্ট্রদূতের কাছে গাড়ি সহযোগিতা চাইলে তিনি বলেন, তার গাড়ি নষ্ট। অবশ্য তখনও আমরা জানি না আমাদের কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। জার্মান থেকে ২৪ আগস্ট আমরা গেলাম ভারতে। ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। উনার মুখ থেকেই শুনলাম আমাদের কেউ আর বেঁচে নেই। কিন্তু কেন যেন ভাবলাম রাসেল হয়ত আছে! শুনলাম আমার এই ছোট ভাইটিও নেই। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে আসব। কিন্তু খুনী মোশতাক এবং পরে জেনারেল জিয়া আমাকে দেশে আসতে দিল না। জিয়া খবর পাঠাল কিছুতেই আমরা দেশে আসতে পারব না। তারপর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে গেলাম ভারতে। এর আগে যুগোশ্লাভিয়া ও জার্মানি আমাদের আশ্রয় দিতে চাইল। ওই সময়ের দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে ৮১ পর্যন্ত ভারতেই ছিলাম। এর মধ্যে লন্ডনে শেখ রেহানার বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু বিমানের টিকেট কেটে বোনের বিয়েতে যাওয়ারও কোন সামর্থ্য ছিল না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেঁচে থাকা একটিমাত্র বোনের বিয়েতেও যেতে পারিনি। কারণ সেসময় টিকেটের টাকা, সেখানে থাকা-খাওয়ার সুযোগ আমাদের ছিল না। আমি একমাত্র বোন হয়েও তাঁর বিয়েতে থাকতে পারিনি। এ সময় তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমাদের হাত-পাতার স্বভাব ছিল না। কষ্ট বুকে চেপে রেখেছি, কাউকে প্রকাশ করিনি, কারও কাছে মাথানত করিনি। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হতাকা- নিয়ে প্রথম বিরোধিতা হয় সুইডেনে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে বাঙালী কমিউনিটি একটি আলেচনা সভার আয়োজন করে। সেখানে শেখ রেহানা উপস্থিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে রেহানা প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখে। তিনি বলেন, এরপর আমি লন্ডনের যাওয়ার পর নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে থাকি। সুইডেনের পার্লামেন্ট মেম্বাররা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিশন করে। সেই তদন্ত কমিশন বাংলাদেশে আসতে চাইলে জিয়া তাদের দেশে আসার অনুমতি দেয়নি। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসলাম, লাখো মানুষের ঢল। বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে এলাম। মুষলধারে বৃষ্টি-ঝড়। ৩০ জুলাই যখন বিদেশে যাই তখন বিমানবন্দরে মাসহ শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের সবাই ছিল। ৮১ সালের ১৭ মে যখন ফিরে আসি লাখো মানুষ ছিল, কিন্তু মা, বাবা, ভাই কাউকে পাইনি। লাখো মানুষের মাঝেই খুঁজেফিরি আমার পরিবারের সদস্যদের। পরিবারের সবাইকে হারালেও দেশে ফিরে দলের অসংখ্য মানুষের ভালবাসা ও সমর্থন পেয়েছিলাম। দেশে ফিরলেও জিয়াউর রহমান তাঁকে ৩২ নম্বরের বাসভবনে প্রবেশ করতে দেয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৮১ সালে বিমানবন্দর থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসি। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেয়নি। জিয়ারউর রহমান ওই বাড়ি আমার জন্যে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। বড় তালা ঝুলানো ছিল। পরে ৩২ নম্বরের বাড়ি সামনে রাস্তায় মিলাদ, দোয়া ও মোনাজাত করে ফিরে আসি। জিয়া যতদিন বেঁচে ছিলেন, ওই বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অবশ্য জিয়া আমাকে অনেক বাড়ি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি নেইনি। আমি বলেছিলাম- খুনীর কাছ থেকে আমি কোন সুযোগ নেব না। এর আগে আমি যখন ভারতে, লন্ডনে ছিলাম জিয়া সফরে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। আমি সাফ বলেছি, খুনীর চেহারা দেখতে চাই না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ৩০ মে জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর ১২ জুন দুপুরে হঠাৎ আমাকে জানানো হলো ৩২ নম্বরের বাড়ি আমাকে হস্তান্তর করা হবে। তখন আমার ছোট ফুফা বললেন, আইনজীবীর মাধ্যমে এ বাড়ি নিতে হবে। তখনও জানি না কেন বাড়ি হস্তান্তরের জন্য এত তাড়াহুড়ো। তিনি বলেন, ৩২ নম্বরের বাড়িতে যখন যাই আমি ভেতরে ঢুকতে পারছিলাম না। বাড়ি ভেতরে সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠি, অর্ধেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই আমি চিৎকার করে উঠি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অর্ধচেতন অবস্থায় বাড়ির ভেতরে নিয়ে আমার কাছ থেকে অনেকগুলো কাগজে স্বাক্ষর নেয়। কিন্তু তাড়াহুড়োর উদ্দেশ্য ঠিক তখন বুঝিনি। তিনি বলেন, পরে বুঝলাম এত তাড়াহুড়ো করে বাড়ি হস্তান্তরের কারণ। ঠিক যেভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগে তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বিরুদ্ধে বদনাম, চরিত্রহনন, অপপ্রচার করা হয়েছে, তার আরেকটা পর্ব শুরু হলো বাড়ি হস্তান্তরের পরে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ওই বাড়ি লুটপাট করা হয়েছে। ৬ বছর পর আমার কাছে বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে। ৬ বছর ওদের হাতেই বাড়িটা ছিল। সেই বাড়িতে কি সম্পদ থাকতে পারে যে, আমাকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, তারপর দেখা গেল ৪০ দিন পর্যন্ত টেলিভিশনে জিয়াউর রহমানকে সাধু বানানো আর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চরিত্রহনন, অপপ্রচার চালানো হয়েছে। কতবড় মানসিক যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে, একটু চিন্তা করে দেখুন। কত প্রতিকূল অবস্থায় আমাকে চলতে হয়েছে। হত্যার পরেও নিষ্ঠুরতা। যারা এদেশের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি- তারাই ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭৫-এর পর এদেশে বঙ্গবন্ধু যেন নিষিদ্ধ ছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি যখন টেলিভিশনে আমরা দু’বোন দেখছিলাম তখন আমরা বলছিলাম- এক সময় এক সময় বাবার ছবি টেলিভিশনে দেখানো হলে সেইসময় টেলিভিশনে ঝির ঝির করে ফেলা হতো। কোথাও কোন জটলার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকলে সেটাও কাগজ দিয়ে ঢেকে ফেলা হতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া খুনীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছে। পরবর্তীতে এরশাদও খুনীদের রাষ্ট্রপতির প্রার্থী করেছেন। খালেদা জিয়া এসেও দুই খুনীকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী করে এনে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছেন। পরবর্তীতে খুনীদের মন্ত্রী বানিয়েছে, তাদের সংসদে বসিয়েছে। খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে। কতবড় অপরাধ সে করেছে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করেছি, বিচারের রায় কার্যকর করেছি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, গ্রেনেড হামলা, জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ, ষড়যন্ত্র অনেক কিছুই মোকাবেলা করেই আমরা দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এখন একটাই কাজ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। যে দুঃখী মানুষের জন্য আমার বাবা, মা, ভাইরা রক্ত দিয়েছেন, সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদল করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য ও শপথ। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে আমরা দেশকে গড়ে তুলবোই- শোক দিবসে এটিই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। পিতা তোমাই কথা দিলাম- দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই।
×