ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার ২০৪১ সাল সামনে রেখে তৈরি করেছে পরিকল্পনা;###;প্রতিদিন কৃষি শ্রমিক কমায় যন্ত্রের কোন বিকল্প নেই

কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ॥ দীর্ঘমেয়াদী কর্মযজ্ঞের রোডম্যাপ অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ আগস্ট ২০১৬

কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ॥ দীর্ঘমেয়াদী কর্মযজ্ঞের রোডম্যাপ অনুমোদন

এমদাদুল হক তুহিন ॥ কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে সম্প্রতি সরকার অনুমোদন দিয়েছে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ’, যা কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কর্মযজ্ঞ। মহা এই কর্মপরিকল্পনায় তিন ধাপে ২০৪১ সাল পর্যন্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে শস্য রোপণে ২০ শতাংশ পর্যন্ত যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। রোপণ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার তা ৮০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। আর ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্য থাকলেও ’৪১ সালের মধ্যে কৃষির প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যবহারের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্য সরকারের। কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রান্তিক কৃষকের মাঝে যান্ত্রিক সুবিধা সম্প্রসারণে কৃষক পর্যায়ে ভাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি সেবা প্রদান প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এতে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং কৃষির পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা জরুরী বলেও মত দেয়া হয়। এছাড়াও দেশীয় যন্ত্র প্রস্তুতকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের দিকে জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি রোডম্যাপটি প্রস্তুত করে, যা সম্প্রতি অনুমোদন দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। সরকারের অনুমোদন দেয়া রোডম্যাপ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ হামিদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষিক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। শ্রমিকরা গ্রাম থেকে শহরে চলে যাওয়ায় বেড়ে চলছে মজুরি, অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হচ্ছে সময় শক্তি। এমন সব পরিস্থিতিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অনিবার্য। আর এ লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদী সময়কে টার্গেট করে এটি একটি মহা-কর্মপরিকল্পনা। তিনি আরও বলেন, কৃষকের কাছে যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করতে এই পরিকল্পনায় নানা উদ্যোগ রয়েছে। যন্ত্র তৈরিতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান যাতে এগিয়ে আসে এবং তারা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ হয় সেদিকেও বিশেষ মনযোগ দেয়া হয়েছে, একইসঙ্গে উপযুক্ত বিদেশী যন্ত্রকে প্রাধান্য দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতির বর্তমান চিত্র ॥ কৃষি যন্ত্রপাতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরে রোডম্যাপে বলা হয়, কৃষিতে জমি তৈরি, সেচ, শস্য মাড়াই ও মিলিংয়ের কাজ প্রায় পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। তবু কোন কোন ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখনও নাজুক। বীজ বপন, রোপণ ও ফসল কর্তনের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়নি। তবে সম্প্রতি কৃষক পর্যায়ে যন্ত্র ব্যবহারের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে অধিকমাত্রায় যন্ত্রের প্রসার ঘটেছে। দিন দিন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে এতে বলা হয়, যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারই শ্রমিক স্বল্পতার এই অভাব দূর করতে পারে। বারি, ব্রি, বিজেআরআই, বিএসডিসি, বিএমপিএ ও ডিএই’র তথ্যালোকে কৃষি যন্ত্রপাতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরে রোডম্যাপে বলা হয়, দেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। আর মাঠে কার্যকর রয়েছে এমন যন্ত্রের সংখ্যাÑ পাওয়ার টিলার ৭ লাখ, ট্রাক্টর ৩৫ হাজার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ৩০০, সিডার ৫ হাজার, দানাদার ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ৮০০, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগযন্ত্র ১৮ হাজার, স্প্রেয়ার ১৩ লাখ। সারা দেশে সেচ পাম্প (গভীর নলকূপ, অগভীর ও শক্তি চালিত পাম্প) রয়েছে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫২টি, আর সৌর পাম্পের সংখ্যা ৩২০টি। অন্যদিকে কম্বাইন হারভেস্টার ৮০, উইডার ২ লাখ ৫০ হাজার, রিপার ৫০০, জুট রিবনার ৪০ হাজার, ওপেন ড্রাম থ্রেসার ১ লাখ ৫০ হাজার, ক্লোজড ড্রাম থ্রেসার ২ লাখ ২০ হাজার, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ১৫ হাজার, আখ মাড়াই যন্ত্র ৫০ হাজার, উইনোয়ার ২ হাজার, ড্রায়ার ৫০০, ধান ভাঙ্গানো যন্ত্র ১৫ হাজার ও ৭০টি ইম্প্রুভড পারবয়েলিং ট্যাংক কৃষি ও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণের প্রতিবন্ধকতা ॥ রোডম্যাপে যান্ত্রিকীকরণের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে কিছু প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করে তার সমাধানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে এমন তথ্য দিয়ে এতে বলা হয়, ক্রমহ্রাসমান জমিতে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিকীকরণ অতি জরুরী। পরিকল্পনায় দেশীয় উপযোগী ও গুণগত মানসম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকরণের দিকে জোর দিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ ॥ বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর অংশ হিসেবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বৃহৎ এই কর্মপরিকল্পনায় ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে স্বল্প মেয়াদী, ২০৩১ সাল পর্যন্ত মধ্য মেয়াদী এবং ২০৪১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে দীর্ঘমেয়াদী গন্তব্য ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি-২য় পর্যায়ের প্রকল্প পরিচালক শেখ মোঃ নাজিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন যেমন প্রয়োজন তেমনি এর পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনও আবশ্যক। সেই ভাবনা থেকে একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, সেই লক্ষ্যমাত্রাকে পূরণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় প্রয়াসে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সময়ে সময়ে কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে।’ রোডম্যাপে বলা হয়, বর্তমানে শস্য রোপণে যন্ত্রের ব্যবহার মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশে উন্নীত করার টর্গেট রয়েছে। আর ২০৩১ সালের মধ্যে রোপণ প্রক্রিয়ার ৪০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এতে বলা হয়, শস্য বপনের ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে বর্তমানে যন্ত্রাপাতির ব্যবহার হয় আর ২০২১ সালে তা ২৫ শতাংশ, ২০৩১ সালে ৫০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৮০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে উল্লেখ করে ২০৪১ সালে তা ৭০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সার প্রয়োগের ১ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ভবিষ্যতে তা ৮০ শতাংশে উন্নীত করার টার্গেট রয়েছে সরকারের। তথ্যমতে, ভুট্টা ও পাট কাটায় বর্তমানে যন্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে ২০৪১ সালের সরকার এ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার ৬০ ও ৮০ শতাংশে উন্নীতকরণের ছক এঁকেছে। রোডম্যাপে মাঠ প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, কৃষকের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং কর্মশালা ও কৃষিমেলার লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি যন্ত্র প্রস্তুতকারকরদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা ও সুদের হার ৫ শতাংশে হ্রাস করার লক্ষ্য রয়েছে। যান্ত্রিকীরণকে আরও জনপ্রিয় করতে রোডম্যাপে ‘কৃষক পর্যায়ে ভাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি সেবা প্রদান প্রকল্প’কে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন আধুনিক কৃষি যন্ত্র জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করা এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে যান্ত্রিক সুবিধা সম্প্রসারণ করাই এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। জানা গেছে, ২০১৫ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘দেশীয় উপযোগী কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন, প্রস্তুতকরণ ও স্থানীয় উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে করণীয়’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরি উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত গবেষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও উদ্যোক্তারা ১৯টি প্রস্তাব দেন, যার মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য রোডম্যাপ তৈরি ছিল অন্যতম।
×